।। বাক্‌ ১২০ ।। জয়দীপ চট্টোপাধ্যায় ।।







ডুবুক


হঠাৎই সাঁড়াশি হয়ে ওঠা উজ্জ্বল ঠোঁট সুন্দর। সাঁড়াশির ফাঁদে যার নিস্তার নেই, সেও... খুব সুন্দর। অথচ মরার আগে জানতেও পারবে না, একজোড়া স্বচ্ছ ফিনফিনে ডানার ওপর কেমন বর্ণালী রেখে দিয়ে গেলো দিনশেষের পড়ন্ত রোদ। এত দূর থেকে সেই রঙের খেলা দেখা যাচ্ছে না, যেমন দূরত্ব বাড়লে অনেক প্রিয়-অপ্রিয় দৃশ্য নজর এড়িয়ে যায়। বরং, খুব কাছে কচুপাতার ওপর বসে থাকা একটা সবুজ ফড়িং-এর ডানায় সেই একই খেলা দেখছিল চিত্ত। চিত্তর উড়ন্ত ফড়িং খপ করে ধরতে ইচ্ছে হয়, বাঁশের ওপর বসে থাকা মাছরাঙা কিংবা হুপি উড়িয়ে দিতে ইচ্ছে হয়, রামধনু ছুঁতে ইচ্ছে হয়। যেমন কিছু দিন আগেই খেজুর রস খেতে ইচ্ছে হচ্ছিল খুব। তবে ওই ইচ্ছে অবধিই। সব কিছু ইচ্ছেমত করা হয় না। করা যায় না। চিত্তর মা এই নিয়ে মাঝে মাঝে গল্প শোনাতো... ওই ইচ্ছেদের বাস্তব না হওয়ার গল্প। স্বপ্ন অপূর্ণ থাকার গল্প। চিত্তকে শোনাতো, না নিজেকেই শোনাতো চিত্ত জানে না। 'লাউড থিংকিং' শব্দটা চিত্তর শোনার বা জানার কথাই নয়। চিত্তর বয়স এখন তেরো, অথচ মনটা পাঁচ বছরের।


--- --- ---




শালগ্রাম শীলা, একটা পাথর বই কিছু নয়। ছুঁড়ে মারলে কপাল আলু হবে, পুকুরে ছুঁড়লে ডুবুক করে তলিয়ে যাবে... খুব একটা ঢেউও উঠবে না জলে। এমন অনেক কিছু মনে হ'তে হ'তে শালগ্রাম শীলাটা ধরে তুলতে গিয়ে ঠাস করে একটা চড় খেয়েছিল চিত্ত। রাধা-গোবিন্দ মন্দিররে হালদার মশাই এমনিতে ঠাণ্ডা মাথার মানুষ। মাঝে মাঝে পরনিন্দা ছাড়া অন্য কোনও বাজে স্বভাব নেই। কিন্তু চান করে সবে মাত্র নারায়ণ-শীলায় ক'টা ফুল চড়িয়েছিলেন... এরই মাঝে মন্দিরের মেঝেতে বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ চৌকাঠ পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়বে কেউ - এটা বুঝতে পারেননি। হঠাৎ সামলাতে না পেরেই হাত ছুটে গেছে। লোকে বলে, চড় না... ধাক্কা দিয়েছিলেন। না হ'লে চৌকাঠের এপারে এসে পড়ল কী করে? চড় হোক, ধাক্কা হোক... ওই হাত ছুট থেকেই। ইচ্ছে করে না। বাচ্চা ছেলে... শিশুর মন। শিশু নারায়ণ। নারায়ণের সামনে কেউ তার গায়ে ইচ্ছে করে হাত তোলে?
বাতাসাটা পাওয়া নিয়ে কথা। গুড়ের লাল বাতাসা। সেদিন দু'টো বাতাসা নিয়ে চিত্ত ফিরে এলো। মাকে কিছুই বলেনি। আর বাবার সঙ্গে তো কথাই হয় না। ওদের ঘরে কোনও শালগ্রাম শীলা নেই। মা-কালীর বাঁধানো ছবি আছে। একটা দাড়িওয়ালা লোকের ছবি আছে পুরনো ক্যালেণ্ডারে। তার গায়ে ঝুল জমেছে। পাখা চললে ক্যালেণ্ডার ওড়ে। ঝুল ওড়ে। দাড়িওয়ালা লোকটা ওড়ে - বলতে নেই। মা প্রণাম করে লোকটাকে রোজ। কেমন অল্পচোখ বন্ধ করে, অল্প ঠোঁট ফাঁক করে বসে থাকে লোকটা। কত পুরনো ক্যালেণ্ডার। চিত্তদের ঘরে কোনও নতুন ক্যালেণ্ডারও আসে না। এই পুরনো ক্যালেণ্ডারটা, ওই লোকটার জন্যই টিকে গেল।
চিত্ত যে একেবারে চড় খায় না তা নয়। বাবা কথা না বললেও মাসে এক আধবার চড় বা ধাক্কা লাগিয়ে দেয়। মা বলে - বাবা'র তখন মাথার ঠিক থাকে না। এই 'মাথার ঠিক' ব্যাপারটা কেমন চিত্ত বুঝতে পারে না। মন্দির থেকে ফিরে সেদিন পুকুরের ধারে বসে বসে এই 'মাথার ঠিক' ব্যাপারটা নিয়েই ভাবছিল। মাটির শালগ্রাম, ইটের শালগ্রাম, স্টোন চিপের শালগ্রাম... এক এক করে পুকুরের জলে ছুঁড়লো। তারা এক এক করে ডুবুক, টুবুক, ঝুপ শব্দ করে তলিয়ে গেলো। চিত্ত ওই ক্যালেণ্ডারের লোকটার মত চোখ অল্প ফাঁক রেখে, আর মুখ অল্প খোলা রেখে জলের দিকে তাকিয়ে তেচোখো মাছদের দেখে গেলো। ওর মনেই নেই... একটা বাতাসা প্যাণ্টের পকেটে গলতে শুরু করেছে... তার দিকে এগিয়ে আসছে সুরসুরে কালো পিঁপড়ে লাইন দিয়ে। কী করে মনে থাকবে? মনটা তো পাঁচ বছরেরই... বয়স যতই তেরোর কাছাকাছি হোক।


--- --- ---


চিত্তর বয়সী ছেলেরা ফেল করতে করতেও পাশ করে যায়। কেউ এক ক্লাসে পড়ে থাকে না। ফাইভ-সিক্স-সেভেন... এই ভাবে উঠে যায়। ধোঁয়া টানতে শেখে, বাবার জামার পকেট থেকে টাকা সরানোর মধ্যে অ্যাডভেঞ্চার খুঁজে পায়। দেরি করে বাড়িতে ফেরার স্বাদ পায়। স্কুল পালিয়ে খেলতে যায়, খিস্তি দেয় সাইকেল করে যেতে যেতে। চিত্ত দেখেছে - কেউ কেউ পুকুর ঘাটের আশেপাশে লুকিয়ে থাকে, যখন মেয়েরা চান করতে নামে। চিত্ত আরও অনেক কিছু দেখেছে। কিন্তু সব সময় সব কিছু বুঝতে পারে না। ঘরের আলো নেভানো থাকলেও রাতে এমন অনেক কিছু দেখতে পায়, যা বুঝতে পারে না। ওই ছেলেগুলো থাকলে ঠিকই বুঝতে পারত। বুঝেও কি চিত্তর মতই পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ত? কানে আসা নানারকম শব্দগুলোকে উপেক্ষা করে বেড়াল আর হাঁসের কথা ভাবতে ভাবতে আচ্ছন্ন হয়ে যেত নিজের মধ্যে? এই বেড়াল, হাঁস... এরা খুব ভাল ঘুম পাড়াতে পারে। পাঁচিল থেকে কার্নিশ, কার্নিশ থেকে ছাতের আলশে... সেখানে থেকে আবার কার্নিশ, সেখান থেকে টালির চাল - বেড়ালটা এগিয়েই চলেছে। সবুজ টল টলে জলে ভেসে বেড়াচ্ছে পাতি হাঁস। এক একটার এক এক রকম রঙ। ঘুরে ঘুরে এদিক ওদিকে ভেসে যাচ্ছে। ঠাণ্ডা গাছের ছাওয়া, ঘুম ঘুম দুপুর।
এই ছেলেগুলো কেউই চিত্তর বন্ধু নয়। কিন্তু অনেকেই চিত্তকে চেনে। এদের দেখলে চিত্তর অস্বস্তি হয় না, অসুবিধে হয় এরা খিস্তি দিলে। ঢোকাচ্ছে, লাগাচ্ছে, ঠাপাচ্ছে... এরকম কিছু কথা শুনলেই ঘেমে যাওয়া বাবার কালো শরীরটা তাড়া করে চিত্তকে। কেউ তাড়া করলে চিত্ত চট করে পালাতে পারে না। হোঁচট খায়, হুমড়ি খেয়ে পড়ে। কেটে-ছড়ে যায়। একটা পাঁচ বছরের বাচ্চার মন নিয়ে কত দূরই বা পালানো যায়! চিত্তর বয়স প্রায় তেরো, তবুও ইস্কুল আর যাওয়া হ'ল না।



--- --- ---


স্টেশনের ধারে যে একতলা বাড়িগুলো, সেখানে তারাই থাকে যারা রেলে কাজ করে। ওই বাড়িগুলোর সামনে সুন্দর বেড়া দেওয়া থাকে। একরকম দেখতে বেড়া সবার বাড়ির সামনে। আর বেড়ার ওপারে ছোট ছোট গাছ। বাড়িগুলোর বাইরের দিকে করে একটা হলুদ আলো জ্বলে। ওয়াট, পাওয়ার... এসব জানলে চিত্ত বুঝতে পারতো - ওগুলো ষাট ওয়াটের বাল্ব। সদর দরজার মাথায় থাকে, সন্ধের পর অনেকে জ্বালিয়ে রাখে। চিত্ত শুধু সন্ধেবেলা স্টেশনের পাশের রাস্তা দিয়ে যাওয়া-আসা করার সময় দেখেছে হলুদ উঠোন। বেড়ার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসা ডোরাকাটা হলুদ আলো-ছায়া। দিনের বেলা এই বেড়ার ওপরেই টুনটুনি, ফিঙে, দোয়েল... এরা এসে বসে। চিত্ত নাম জানে না, কিন্তু আলাদা আলাদা দেখতে - বুঝতে পারে। এই বেড়াগুলোর ওপরেই বসে থাকে গিরগিটী - গার্ডেন লিজার্ড। ঘরের টিকটিকির মত ছা-পোষা ঘরের পোকা খাওয়া চেহারা নয়। দেখলেই বোঝা যায় অন্যরকম। কেমন লম্বা ল্যাজ! কেমন তাকিয়ে থাকে ঝিমনো চোখ নিয়ে। অথচ এত কিছুর মাঝেও দিনেরবেলা বেড়াগুলোর কোনও প্রাণ নেই। কোনও মায়া নেই। কোনও যাদু নেই। কিন্তু অন্ধকার নেমে এলে, হলুদ আলোগুলো জ্বললেই বেড়াগুলো কেমন অন্য রকম হয়ে যায়! বেড়া ছুঁয়ে ছুটতে ছুটতে চিত্তর নিজেকেই ট্রেন মনে হয়। একের পর এক বেড়ার হলুদ-কালো ডোরা পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে চিত্ত। হাওয়াই চটির তলায় কাঁকড়, রাস্তার ছোটোখাটো গর্ত, ইটের টুকরো... কাউকে পাত্তা না দিয়ে ছুটে যাচ্ছে চিত্ত লোকাল, সবেদাবাগান জংশনের দিকে। ইঞ্জিন, জ্বালানি, রেল লাইন... এরা চিত্তর মনে কতটা জায়গা পেয়েছে আলাদা করে, জানা নেই। তবে চিত্ত নিজে একটা আসত ট্রেন হয়ে এই ভাবেই ছুটে যেতে পারে। আসলে, ওই যে কয়েক বার মা'র সঙ্গে মামার-বাড়ি গেছিল ট্রেনে করে... সেই ভাল লাগাটা মনে থেকে গেছে। মামার বাড়ি তো নয়, দাদুর বাড়ি। মামা-ফামা কেউ থাকে না। এক মামা ছিল, সে শহরে পালিয়েছে চাকরি নিয়ে। মা যেত বুড়ো দাদুর খোঁজ নিতে, সে মরে যাওয়ার পর আর যায়নি। তাই চিত্তরও ট্রেনে ওঠা হয়নি আর।
মা কেন আর সেখানে ট্রেনে করে যেতে চায় না? বুড়ো দাদু মরে যাওয়ার পর সেই দাদুর-বাড়িটার কী হ'? বাবা কেন কোনও দিন ট্রেনে করে যেতো না? এই প্রশ্নগুলো ভাবলে, এর উত্তরগুলোর খোঁজ করলে চিত্ত সত্যিই অনেক বড় হয়ে উঠত। তাহলে হয়ত আর নিজেরই জংশন থেকে জংশন ছোটার ইচ্ছেটা থাকত না হাওয়াই চটি পায়ে।
তবে মাকে শেষবার যখন স্টেশন থেকে ট্রেনে করে যেতে দেখেছিল, সেইবার মা চিত্তকে নিয়ে গেল না। একটা ঝোলা ব্যাগ আর ভাইকে নিয়ে গেল কোলে করে। কেমন একা একাই চোয়াল শক্ত করে চলে গেল, একবারও পেছন ফিরে না দেখে। চিত্তকে না খুঁজে। চিত্তর বয়স তেরোই প্রায়, অথচ মনটা পাঁচ বছরের কচি। তবুও মায়ের এই চলে যাওয়াটা দেখে খুব কষ্ট হচ্ছিল।
"মা একবারও আমাকে ডাকল না? আমাকে খুঁজল না? দেখতে পেলো না?"



--- --- ---




লোকে বলে - চিত্তর মাকে আটকানোর চেষ্টাই করেনি ওর বাপ।
আসলে চেষ্টা করলেও সুবিধে করে উঠতে পারত না, ওর মা আর থাকবে না ঠিকই করে নিয়েছিল। সহ্যের জল মাথার ওপর দিয়ে বইছে - এই কথাটা চিত্তও অনেকবার বলতে শুনেছিল ওর মা'কে। নিন্দুকেরা কেউ কেউ বলে পার্টি অফিসের দীপেনের সঙ্গে না শুলে সদরহাটের ইস্কুলে রান্নার লোকের কাজটা পেতোই না। তবে চান করতে করতে বউ-ঝিরা এমনও বলেছে "ওই পাষণ্ডর ঘরে সতী সেজে পড়ে থাকার চেয়ে বেরিয়ে নিজে বাঁচুক গে... মোদোমাতালের ঘরে কী পেতো আর? ওই তো ছিরি!... কোলের ছেলেটাকে বাঁচাক এই পাপের থেকে দূরে নিয়ে গিয়ে !"
চিত্ত সেসব কিছু শোনেনি। বছর পাঁচেকের মনে অত কথা ঠাঁই পায় না। তবে দেখল, মা চলে যাওয়ার পরে অনেক জিনিসই ওর বাবা টানা মেরে ঘরের বাইরে ফেলে দিচ্ছে। অতদিনের পুরনো ক্যালেণ্ডারটাও ফেলে দিলো। ক্যালেণ্ডারের লোকটার জন্যেও কষ্ট হচ্ছিল চিত্তর। কিন্তু চিত্তর মত কষ্ট ওর বাবারও হচ্ছে কি না বুঝতে পারল না।


লোকজন এমনিতেই বলত... মানে, ওই রাধা-গোবিন্দ মন্দিরের হালদার মশাইও বলতেন - এমন ছেলে বেশিদিন থাকে না। আর থাকলেও কষ্ট, না থাকলেও কষ্ট। মা বাপের পর কে যে দেখবে! কী যে করবে!... ইত্যাদি।
তবে চিত্তকে দেখার চিন্তা আর কাউকেই সেভাবে করতে হয়নি। হবেও না।
শালগ্রাম শীলা, কিংবা ক্যালেণ্ডারের লোকটার থেকে চিত্ত ভাল আছে। ইচ্ছে হলেই বেড়ার পাশ দিয়ে লোকাল ট্রেন হয়ে ছোটে। খেজুর গাছের তলায় বসে খেজুর-রস নামানো দেখে। মন্দিরের পিঁপড়েদের সঙ্গে লাইন দিয়ে বাতাসা খায়। মায়ের মুখটা মনে পড়লে পানকৌড়ির মত দিঘীর জলে ডুবে যায়। ডুবুক!
এই যেমন এখন ফড়িং-এর ডানায় আটকে পড়া পড়ন্ত রোদ্দুরের রঙ দেখে যাচ্ছে এক মনে।
চিত্তর মনের বয়স এখনও পাঁচই আছে। আর ওর নিজের বয়স ঠিক ঠাক হিসেব করলে - বারো বছর, 'মাস, একুশ দিন। চিরকাল সকলের কাছে ওটাই থেকে যাবে।


No comments:

Post a Comment