চিত্রঋণ – প্রদোষ পাল |
চলে গেলেন মণীন্দ্র গুপ্ত। আমার
অনেক পথপ্রদর্শকের উনি একজন। কবিতার বাইরেও, বাঙালি সমাজে একজন কবিকে কতখানি হতাশা
উগরে দিয়ে বাঁচতে হয়, নিজের সবটুকু তিক্ততা বাইরে ফেলে দিতে হয়, যাতে হেঁটে যাওয়া
যায় অক্ষয় মালবেরি স্পর্শ করে, সেটা আমাকে শিখিয়েছে মণীন্দ্র গুপ্তর একটি
গদ্যগ্রন্থ- ‘চাঁদের ওপিঠে’। যে কবিগণ নিজেদের সফল ভেবে বুঁদ হয়ে আছেন, ওই একটি বই
তাঁদের পড়া উচিত- ‘চাঁদের ওপিঠে’। তবে তাঁরা জ্যোৎস্নার যোগ্য হবেন, মোহমুক্ত চোখে
যে কোনো আঙুল সরিয়ে, তাকাবেন চাঁদের পূর্ণ মাধুরীর দিকে।
কোনো একটি বিশেষ পত্রিকা বা প্রতিষ্ঠান
গ্রহণ বা বর্জন করে কেউ আর বিখ্যাত সাহিত্যিক হবেন না, বিদ্রোহীও হবেন না। সুনীল
গঙ্গোপাধ্যায়ের দিন যেমন আর আসবে না, নতুন কোনো হাংরিও আজ আর জন্ম নেবেন না। এটা
২০১৮। সাহিত্যিকদের পক্ষে আজ সাহিত্যগুণে সেলেব্রিটি হওয়া অসম্ভব। কোনো চে
গ্যেভারা আজকের বাংলা কবিতায় নেই। অডিও আর ভিডিওর দিনই যেখানে সম্পৃক্ত হয়ে আসছে,
তখন বাংলা কবিতার বুকে সমবেত বিপ্লব হবে, এই স্বপ্ন দেখতে দেখতে আমার চোখ ব্যথা
করে আসায়, আপাতত আমি চোখ বুজেছি। ব্যক্তিগত অন্ধকারে আরো ভালো দেখতে পাওয়া যায়।
অন্ধকার একজন প্রাচ্য কবির সম্পদ। বাংলার জনজীবন অন্ধকারকে তার ক্ষুধা আর তৃষ্ণার
থেকে আলাদা করে না।
বাঙালি পাঠক আজ গল্প-উপন্যাসের
প্রয়োজন খুব যে একটা বোধ করছেন, এটা চারদিকে তাকিয়ে মনে হয় না। আপাতত বাংলা
সাহিত্যের কোনো আন্তর্জাতিক মূল্য নেই, জাতীয় গুরুত্বও কি আছে? ভারতের অন্য
রাজ্যগুলোয় বাংলা সাহিত্য কতটুকু পড়া হয় আজ? বাঙালির প্রবন্ধ এখন অনেক হার্ডকোর
পাঠককেও বোরড্ করে দিচ্ছে। কবিতার প্রয়োজন আপামর বাঙালির সেদিনই ফুরিয়েছে, কবিতা
যেদিন পাঁচালি আর পয়ার অতিক্রম করে বিশ্বজনীন হতে চেয়েছে। কবিতা সেদিন থেকেই
অসাধারণ বাঙালির চর্চার সামগ্রী। ফেসবুক আসার আগে অসাধারণ বাঙালিরা কবিতা পড়তেন।
ফেসবুক এসে পড়ার পরে অসাধারণ ‘কবিতাপ্রিয়’ বাঙালিরা প্রায় ৯৯ % ক্ষেত্রেই কবিতা
লিখছেন, অন্যদের কবিতার প্রতি তাঁদের পিপাসা দিনে দিনে মিলিয়ে আসছে। কবিতা লেখার
যাবতীয় রহস্য আর কলাকৌশল শিখে নেওয়া যে ঐকিক নিয়ম শেখার চেয়ে খুব কঠিন নয়, এটা
তাঁদের বদ্ধমূল ধারণা হয়ে আসছে। দক্ষতার অবসান যে দক্ষযজ্ঞে, এটা তাঁদের বোঝাবে
কে?
আজ প্রতিটি পত্রিকাই লেখা ছাপার
জায়গা। চিরকালই ছিল, যেখানে প্রমথ চৌধুরী-জলধর সেন-সঞ্জয় ভট্টাচার্যর মতো
সেনাপতিরা অনুপস্থিত ছিলেন। অপ্রস্তুত কিন্তু জনসংযোগে পটু সম্পাদকরা আত্মশ্লাঘা বোধ
করতে পারেন, তাঁর পত্রিকা নিছক ছাপার জায়গা নয়, কিন্তু লেখক-সম্প্রদায়ই একটি
অভিমুখহীন পত্রিকার চরিত্র নির্ধারণ করে, সম্পাদক করেন না। সম্পাদক যদি সোল্লাসে
তাঁর লেখকদের অশিক্ষা আর কুরুচিকর আচরণকে প্রশ্রয় দ্যান, সমর্থন জানান, বুঝতে হবে
সেই পত্রিকা টয়লেট পেপার হওয়ার যোগ্যতা অবশ্যই অর্জন করে ফেলেছে। নির্বাচিত লেখককে
দেখেই পত্রিকা চেনা যায়। অশিক্ষিত ও অপ্রস্তুত সম্পাদকের আস্থা থাকা দরকার তাঁর
লেখকের প্রতি। যারা লেখে, সবাই লেখক নন, কেউ কেউ বাতেলাবাজ ‘লিখিয়ে’-ও আছেন।
লেখকের একটা বিপুল গুণ তাঁর উৎপাদন শক্তি। এবং, তাঁর স্বার্থপরতা। অপ্রস্তুত সমাজে
একজন লেখককে আত্মকেন্দ্রিক হতে শিখতে হয়। আত্মরক্ষার জন্য ওটা জরুরি। অযোগ্য
সম্পাদকের প্রতি কৃতজ্ঞতা তাঁর মৃত্যু ঘটাতে পারে। বিশেষ পত্রিকা-গোষ্ঠী তাঁকে
লেবেল দেবে, কিন্তু প্রয়োজনীয় লেভেল দেবে না।
বিশেষ পত্রিকার প্রতি অনুগত
লেখকরা বিরল নন। ওটা কর্পোরেট চাহিদা। কর্পোরেট
সম্পাদকরা লেখককে নিজের উৎপাদিত সামগ্রী ভাবেন, এবং কুক্ষিগত করে রাখতে চান।
তাঁদের নীতি- “তোমরা আমাকে আনুগত্য দাও, আমি তোমাদের জনপ্রিয়তা দেব।” এই দাবি না মানলে যোগ্যতম লেখকেরও একটি পত্রিকায় অপরিহার্য হওয়া হয় না, অবান্তর হয়ে যেতে
হয় তাঁকে। আমরা ‘বাক্’-এ ঐ নীতি নিতে চাই না। যাঁরা ভাবছেন বিশেষ লেখককে
বিচ্ছিন্ন করলে ‘বাক্’ ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, তাঁরা জানেন না, ‘বাক্’ বহুবার
ছিঁড়েছে, আবার জুড়ে গেছে। আজ যদি আমি নিজেও বেরিয়ে যাই, ‘বাক্’ চলবে।
আমি আজ নিজের সম্পাদক পরিচয় নিয়ে
যথেষ্ট অস্বস্তিতে আছি। বিকেন্দ্রিকরণ চাইছি। সম্পাদকের বাড়াবাড়ি আধিপত্য
পত্রিকাকে মৌলবাদ আর সাম্রাজ্যবাদের দিকে নিয়ে যায়। আমরাও চাই নিজস্ব লেখক। কিন্তু দাবি করতে পারি না
একজন শুধু ‘বাক্’-এর লেখক হয়ে থাকবেন। এটুকুই বলতে পারি অজস্র ওয়েব ও
প্রিন্ট-ম্যাগে ‘বাক্’-এর নিয়মিত লেখকদের দেখা যেতে থাকলে, আলাদা করে ‘বাক্’
প্রকাশের অর্থ থাকে না। কিন্তু, এটাও ঠিক, লেখককে ‘বাক্’ তার অংশ হিসেবেই পেতে
পারে, অঙ্গ হিসেবে নয়। একজনের একটা দুর্দান্ত লেখার মূল্য, তাঁর নিজের চেয়ে বেশি।
সেটা পেলে তিনি আর কোথায় কোথায় লেখা ছড়াচ্ছেন, একটি সুস্থ পত্রিকার সেটা দেখার
অর্থ হয় না।
ক্ষুদ্র একজন সম্পাদক হিসেবে গত
প্রায় এক দশকে আমি এটুকু করেছি, কারো লেখা ছাপার বা না-ছাপার সময় সে আমার
ব্যক্তিগত শত্রু না মিত্র, সেদিকে তাকাইনি, আমাকে অপমান করেছে কিনা পরোয়া করিনি, কিন্তু,
‘বাক্’-এর শত্রুদের চিহ্নিতভাবে ষড়যন্ত্রের সাফল্য থেকে দূরে রাখতে চেয়েছি। যদি
কেউ ‘বাক্’-এ কোনোভাবে ব্রাত্য হয়ে থাকে, সেটা শুধু এই কারণে যে সে ‘বাক্’-এর
প্রতি অসূয়া পোষণ করেছে, প্রকাশ্যে অপমান করেছে, ক্ষতিসাধন করার চেষ্টা করেছে, আড়ালে
কুৎসা করেছে, অকারণে, অযৌক্তিকভাবে, তারপর রহস্যময়ভাবে লিখতেও চেয়েছে এই পত্রিকায়।
‘বাক্’ এক মুক্ত পরিসর। কিন্তু,
এমনকি, ন্যুডিস্ট কলোনিতেও কিছু মর্যাদা থাকে, আত্মরক্ষা থাকে, সীমানা আর আশঙ্কাও তো
থাকেই।।