তপোভাগ
এক : আত্রেয়
খানিক অস্বস্তি হয় আত্রেয়র। এত ঘনঘন খাদ্যগ্রহণ তার অভ্যাস নেই। আর এরা, সর্বদাই খাদ্য উপস্থিত করছে। দুই তিন দণ্ড পর পরই কিছু না কিছু এসে যাচ্ছে।
লোভও হয়, সত্যিই। সুগন্ধ, দৃশ্যতও সুন্দর। দেখে তা গ্রহণ করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু উদর তার অভ্যাসের বাইরে পড়ে চমকে যাচ্ছে, হাঁপিয়ে পড়ছে। দীর্ঘক্ষণ ধরেও রাখছে না। ফলে যা হবার। বারবার।
প্রথম তিনদিন এভাবে চলার পর তিনি নিষেধ করে দিয়েছেন। এখন তারা, তাঁর আদেশ না পেলে খাদ্য আনে না।
আসলে, তার অভ্যাস দিনে মাত্র একবার মলত্যাগ করা। সূর্য উঠবার আগেই, সে কর্ম সেরে নিয়ে শৌচকর্মাদি দন্তধাবন এবং স্নান। মরুৎ পর্বতের নিচের উপত্যকার ওই ফালি জলাশয়টিকে এখনও, এই বয়েসেও প্রস্থের দিকে তিনি সন্তরণে পার হতে পারেন। রোজ হ'ন না। পাঁচ - ছয়দিনে একদিন। অন্যদিনগুলিতে ঝপাস ঝপাস করে গুটিকতক ডুব দিয়েই স্নানকর্ম সমাধা হয়। অঙ্গবস্ত্রও প্রত্যহ ধৌত করেন না তিনি। প্রত্যহ ধৌত করলে বস্ত্র আহত হয়, তার আয়ু কমে যায়, এ তিনি অভিজ্ঞতা থেকে জানেন। আর, আসল কথা হলো ধৌত বস্ত্রে একটা খড়খড়ে ভাব থাকে, যা তাকে অস্বস্তি দেয়। কিন্তু অধৌত বস্ত্র যেন তার অঙ্গচর্ম, তার মধ্যে তিনি অবলীলায় প্রবেশ করে যান।
ধূমল পর্বতের নিজের জলাশয়টি বিপজ্জনক। সন্নিহিত বৃক্ষের মূলে এক বৃহৎ অজগরের বাস, এ খবর আটবিকরা দিয়েছিল প্রথমে। তিনি মানেননি। পরে দেখেছেন সেইটিকে। সত্যিই বৃহৎ। অবশ্য তিনি ওই জলাশয়ে স্নান করেন না, শুধু মাটি আনতে যান, তাও যেপ্রান্তে সেই মহানাগ বাস করে, তার বিপরীত প্রান্তে, উত্তর-পশ্চিম কোণে। তথায় একধরণের পিঙ্গলবর্ণ কর্দমপিণ্ড রয়েছে, পাড়ের কাছাকাছি, বর্ষার সময় স্থানটি জলে ডুবে যায়, শীতের শেষে বসন্তের দিকেই তিনি তা সংগ্রহ করে নেন। সেই কর্দম মাথায় মেখে স্নান করলে, চুলে জটা পড়ে না।
এই একটিই বিলাস তার। বিলাস নাকি ব্যসন বলে একে? কিন্তু আত্রেয় জানেন, তা তার প্রয়োজন। মস্তকের জটভার। কম বয়েসে ব্রহ্মচর্যকালে গুরুসেবার নিত্যদিন, নানাবিধ উন্মত্ততার সে জীবৎকাল, অনিয়মে দুদিনেই চুলে জট পড়ে যেত, কেশরাশি উৎপন্ন হতো প্রচুর, তবু তখন সমস্যা হতো না, আরও একটু বয়েস হতেই দেখলেন, জট কখনো সম্পূর্ণ মস্তকে সমভাবে ভার ছড়িয়ে পড়ে না। এক না একদিকে ঈষৎ ভার বেশি থাকেই। তাতে মাথা হেলে থাকে অল্প। আর, দীর্ঘকাল হলে জটভার বেশি হয়ে যায়। সে বিশ্রী অবস্থা। নির্জনে বসে তত্ত্বচিন্তা করবার সুযোগ নেই, মাথা নিয়েই মাথাব্যথা। চেতনা মাথার হেলে থাকার পেছনে ঘুরে মরে। তিনি তবুও প্রথা মেনে অন্যদের মতো জটভারে মস্তক শোভিত করতে চেয়েছিলেন। কয়েকবার চেষ্টার পর বুঝে যান, এ তার পন্থা নয়। এক ক্ষৌরকার ডেকে মস্তক মুণ্ডন করে দুইমাসের জন্য ঢুকে যান গভীর জঙ্গলে। তার আগেই আটবিকদের কাছ থেকে তিনি এই মৃত্তিকার গুণ জেনেছিলেন। দুইমাস পর বেরিয়ে আসেন, উর্ধ্বে চূড়া করা সুবিন্যস্ত কেশ নিয়ে।
যদিও, আর কেউ না জানুক, তিনি নিজে জানেন, তাঁর স্বভাবটি প্রকৃত অলসের স্বভাব। মৃত্তিকা থাকতেও, রোজ রোজ ঘষতে ইচ্ছে করে না তাঁর। ওই যে, পাঁচ ছয়দিবস। পাঁচ ছয়দিবস পর, চুলে হাত দিয়ে তার যদি মনে হয় যে এবার কিন্তু জট পড়ে যাবে, তখন। জলাশয় তোলপাড় করে স্নান, এপার ওপার, দীর্ঘ গাত্রমার্জনা, এবং স্নানের পর সরোবরতীরের মৃদু বায়ে রৌদ্রস্নান ও বিশ্রাম। খাদ্য? খাদ্যের কথা কে চিন্তা করে? ও প্রাণধারণযোগ্য খাদ্য ঠিক জুটে যায়, কখনো দেরি হয়, তা তো হতেই পারে। তিনি তো আর মৃগ গবাদি নন, যে তৃণমাত্রই ভোজন করবেন! এই যে বন্য তরক্ষুদল, এরা কি দিনে চারবেলা পর্যাপ্ত আহার পায়? যখন যেমন জোটে। এটাই প্রাকৃতিক। যখন যেমন জোটে। খাদ্য নিয়ে ভাববে মনুষ্যেতর প্রাণীরা, সারাদিন খাদ্যের সন্ধানেই তাদের জীবনযাত্রা। তিনি মানুষ হয়ে জন্মলাভ করেছেন, কতো উচ্চ বংশে তাঁর জন্ম, তিনি সামান্য উদরপূর্তি নিয়ে মস্তক ঘর্মাক্ত করবেন? ধিক!
অবশ্য তাঁর পরিবর্তনের প্রয়োজনও ছিল। শমদমাদি অভ্যাস তার অঙ্গে অঙ্গে, তবু শরীর, শরীরের নিয়মে চলে। কোন কোন সময়ে, দীর্ঘকালের পরেও হতে পারে বা ততো দীর্ঘ অবসরে নয়, তাঁর মনে কিছু সুখাদ্যের চিন্তা আসে, সুখশয্যা। আরো কিছু অনুষঙ্গ... আরো কিছু? আরো কিছু কিছুর কথা ভেবে মন উচাটন হয়। তখন তিনি বোঝেন, তাঁর এখন কারো আতিথ্য গ্রহণের সময় হয়েছে।
এই ভবন মনোরম, মূল ভবন থেকে পৃথক, অথচ মূল ভবন সংলগ্নই। শ্বেতবর্ণের এই বাসস্থানে অধিষ্ঠান করে তাঁর প্রাণের প্রান্তে ঈষৎ প্রশান্তির বাতাস বয়, খুবই কুণ্ঠিত ও মৃদুচরণে। প্রশান্তি! ধিক! প্রশান্তি কোন অজমূর্খ চায়? প্রশান্তি চাইলে তিনি বর্তমানের তুলনায় অনেক সহজ জীবনকৃত্যে লগ্ন হতে পারতেন। যদিও মাঝে মাঝে তাঁর বেশ ভালোই লাগছে, তখনই তিনি এই কিশোরীর কথা মনে আনছেন, গূঢ় এক বিরক্তি এসে যাচ্ছে তাঁর চিত্তে, কুঞ্চিত হয়ে উঠছে ভ্রূদ্বয়, অঙ্কিত হয়ে উঠছে ভ্রূমধ্যে শূলচিহ্ন, ধ্বকধ্বক করে জ্বলে উঠছে তাঁর চোখ, মুহুর্তের জন্য।
কিশোরী! কিশোরী কেন? নৃপতির গৃহে কি আর কেউ নেই? আত্রেয় জানেন, সত্যিই নেই, নৃপতি বিপত্নীক। আরো অন্য কন্যাসমা রয়েছে নৃপতির গৃহে। দাসী কিঙ্করীও আছে যথেষ্ট, যদিও দাসীর হাতে তাঁর পরিচর্যার ভার দেওয়ার প্রশ্নই ওঠেনা। ক্ষত্রিয়কে মেনে চলতে হয় তপস্বীর তেজ, নৃপকে ব্রাহ্মণের সেবা করতেই হয় দাসের মতো, নিজহস্তে, স্ত্রীপুত্রকন্যাসহ। এর বিবিধ কারণ। প্রথমত, ব্রাহ্মণ শ্রেণী বিরুদ্ধ মত তৈরি করে জনমানসে বিক্ষোভ তৈরি করতে পারে সহজেই, এই শ্রেণীকে হাতে রাখতেই হয় শাসককে। বোধকরি বিলাস ও আড়ম্বরের জীবন ছেড়ে যাঁরা তপশ্চর্যার কঠিন পথে জীবন অতিবাহিত করে, তাঁদের স্বার্থবোধ থাকেনা বলে মানুষ মনে করে। তাঁদের কথায় সহজেই প্রজাবিদ্রোহ হতে পারে। এছাড়া, এই শ্রেণীর যেহেতু সকল রাজগৃহে অনায়াস গতি, তাই সকলের সংবাদ জানতে এঁদের তুল্য উপায় আর নেই। এ ব্যতীত মাঝে মাঝে এঁরা হঠাৎ একআধটা উপদেশ দিয়ে দেন, যেগুলি খুবই কার্যকর হয়। আরো কারণ বোধহয়, ক্ষত্রাহঙ্কার-শমন। রাজদর্পে ক্ষত্রিয় যেন ভুলে না যায়, যে সে বাকি সব প্রজার মতোই মানুষমাত্র, ব্রহ্মজিজ্ঞাসাপরায়ণ তপস্বী ও ব্রাহ্মণকে সেবার মাধ্যমে নরপতিকে সাধারণ প্রজার স্তরে নামিয়ে এনে সমান করে দেওয়া হয়। কিন্তু এ সমস্তর থেকেও অনেক গভীরে প্রসারিত আছে যে কারণ, তা হলো -- তপোভাগ।
দীর্ঘ সময় পর আত্রেয়র মুখে একচিলতে হাসি ফুটে উঠল। তপোভাগ। তপস্যার ফল, সেই ফলের ভাগ। গৃধ্নুতা? নাকি ভয়? নাকি অনিশ্চয়তা? নাকি সব মিলিয়ে? নাকি আরো কিছু মনস্তত্ত্ব রয়েছে এর মূলে?
তাঁর তপোভাগ প্রাপ্তির আশা করবার সাহস করে, ধরাধামে এমন কেউ নেই। সকলে তাঁর কোপ থেকে বাঁচবার জন্যই সন্ত্রস্ত থাকে। নৃপতি এই কিশোরীকে তাঁর পরিচর্যায় নিয়োগ করলেন কেন? নিজে কেন নিযুক্ত হলেন না? তিনি পুরুষ, তিনি থাকলে আত্রেয় আরো সহজ হতে পারতেন, আরো মুক্তমনে আচার করতে পারতেন। এই কিশোরীকে প্রথম দেখেই কি যেন অস্বস্তি হয়েছে আত্রেয়র। তিনি এখনো ঠিক সহজ হতে পারেন নি।
নৃপতি, কিশোরীটিকে তাঁর দিকে এগিয়ে দিয়ে সরে গেলেন? আড়ালে রইলেন? এ কাজ রাজোচিত হলো কি না, সে প্রসঙ্গ নাহয় থাক, নৃপতি কি তাঁকে নারীলোভাতুর এক নিকৃষ্ট রমণীদাস মনে করছেন নাকি? স্পর্ধা! স্পর্ধা! স্পষ্ট নয়, তাই আরো বিরক্তি, গৃহে তাপস অতিথি হলে গৃহকর্তা-গৃহকর্ত্রীকেই তাঁর সেবার ভার নিতে হয়, আর এই বালিকা এই নৃপতির গৃহের অভ্যন্তরের সব দায়িত্ব সামলায়। নৃপকে যেহেতু রাজকার্যও দেখতে হবে, সেক্ষেত্রে গৃহকর্ত্রীরূপিণী এই নারীই তাঁর সেবার দায়িত্ব নেবেন, এই স্বাভাবিক, তবু আত্রেয়র মনে হচ্ছে এই জরদগব নৃপতিটি তাঁকে রমণীর অঞ্চলনিবদ্ধ কোন সাধারণ বটু ভাবার দুঃসাহস করছে নাকি? অথচ নিশ্চিত কিছু অবধান করাও যাচ্ছেনা, শরীরে একটা অস্বস্তি হচ্ছে, কোন একটি অপরাধ পাওয়া গেলে এখনই নৃপতিকে ডেকে নিজের পদপ্রান্তে নামিয়ে সঠিকভাবে একটি অভিশাপবাণী উচ্চারণ করে আত্রেয় নিজেকে ভারমুক্ত করতে পারতেন! শরীর মন মুক্তপক্ষ বিহঙ্গের মতো লঘুভার হয়ে যেত তাঁর।
কিশোরী সুন্দরী। কিন্তু সে সৌন্দর্য শুধু শারীরী নয়, অন্য কিছু আছে... কি? কি? নারীরূপ তাঁর আরাধ্য বিষয় নয়, কিন্তু কখনও কখনও তাঁর কবির মতো ভাবতে ইচ্ছে করে। বসন্তে যেমন প্রকৃতি পূর্ণ সমারোহে জেগে ওঠে, সেই উল্লাস নয়, ভরা বর্ষার পর শরৎ আগমনের যে সরস সমাহিত ব্যক্তিত্ব, এই বালিকার যেন তা রয়েছে। কোনও কোনও বালিকা থাকে, যাদের একবার দর্শনমাত্রই তার নারীরূপটি উদ্ভাসিত হয়, খুবই বিরল এমন বালিকা, এ তেমনই এক বালিকা, এই বয়েসেই পূর্ণ নারীর অবভাস! যদিও পৃথিবীতে অনেক বৎসর তিনি বাস করছেন, বহু নারী তিনি দেখেছেন। বিশেষ তাঁর গতি অবাধ এবং এ জম্বুদ্বীপের প্রায় সব রাজবংশের নারীই তাঁর পদসেবা করেছে। নারী বলে কাউকে আলাদাভাবে দেখতে হবে, এমন মানসিকতার উর্ধ্বে রাখেন নিজেকে আত্রেয়, পুরুষ হিসেবে কোন নারীর দিকে তিনি তাকাবেন নাকি মানুষ হিসেবে, এ আজ তাঁর নিয়ন্ত্রণে। অথচ এ বালিকাটিকে দেখে হঠাৎ তাঁর পুরুষ চোখ স্বেচ্ছায় বেরিয়ে এসেছে।
এ যে কোন বালিকা নয়। এ বিশেষ। আত্রেয় এক অজানা অস্বস্তি বোধ করছেন।
চলবে...
No comments:
Post a Comment