।। বাক্‌ ১২০ ।। আমার বাবা বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায় ।।





পঞ্চম পর্ব

  কৃষ্ণপদ ভট্টাচার্য টুকটাক  কবিতা লিখতেন সেসব অবশ্য তালপাতায়  শরের কলমে লেখা কখনও কোন কাগজে তাঁর  লেখা প্রকাশিত হয়েছিল কী না কেউ জানত না গাঁয়ে আরও একজন লিখতেন ত্রিগুনাপ্রসাদ ভট্টাচার্যকালি পড়া লন্ঠনের আলোয় একান্তই চুপিসারে পুরানো খাতায় যা মনে আসত সেইসব প্রলাপ লিখে রাখতেন আমার মেজদাদু অতুলপ্রসাদও  লিখতেন সঙ্গোপনে কেউ  জানত না সেসব খবর কোন পত্রিকার পাতায় ছাপা হয়নি তাদের অক্ষরসাধনামনেপ্রাণে কবি ছিলেন কিন্তু এঁরাও সহজ সরল কোন ঝুটঝামেলায় না জড়ানো শান্ত মানুষ সবাই  চারপাশে ঘটে চলা অন্যায় অত্যাচার জুলুমের বিরুদ্ধে নিজের মনের ভেতরের তোলপাড় চেপে রাখতে না পারলে হু হু করে কবিতা হয়ে উঠত পাঁচের দশকে সারা রাজ্যেই তখন খাদ্যের আকাল  বস্ত্রের আকালকোন রকমে একখণ্ড পোশাক পরে লজ্জা নিবারণ করতে বাধ্য হচ্ছে মানুষকখনও বা তাও জোটে না। এর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিবাদ যেমন চলছে পাশাপাশি সাংস্কৃতিক প্রতিবাদও ।এই পরিপ্রেক্ষিতে কৃষ্ণ জেঠুর একটি কবিতা বাবার কাছে খুব শুনতাম –“জয় ব্যোম শঙ্কর/ বস্ত্র অভাবে সাজিব এবার ল্যাংটা দিগম্বর।”বাবা পুরো কবিতাটিই বলতেন দাঁড়ি কমা সমেত।শুনে শুনে যেটুকু মনে আছে তাই উদ্ধৃত করলাম।
তালপাতার গায়ে শরের কলমে লেখা সেই বিদ্রোহের কবিতাটি কোন কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল কীনা আজ আর মনে নেই।
 স্কুলে পড়তে পড়তেই তখন বাবার কবিতা প্রকাশিত হচ্ছে চারদিকে অনেক কাগজে । ছোটদের , বড়দের বিভিন্ন পত্রিকায় । কম বয়সে লেখালেখি নিয়ে প্রত্যেকের মধ্যেই এক লাজুক সত্তা থাকে। প্রকাশিত হলেও কেউ সেই কবিতাগুলি দেখলে ভীষণ  অস্বস্তি হয়। পরে অবশ্য ধীরে ধীরে তা কেটে যায় । তখন যারা কবিতার বোদ্ধা তাদের দেখাতে ইচ্ছে করে। এরকমই এক ইচ্ছে থেকে বাবা কৃষ্ণজেঠূকে একদিন বলল- দেখো, এইসব পত্র পত্রিকায় আমার কবিতা বেরিয়েছে একটু প্রচ্ছন্ন গর্বও ছিল প্রশংসা বা অভিনন্দন যা সাধারণত যেকোন তরুণ কবিই আশা করেন সেরকমই কিছু আশা করেছিলেন বাবা কিন্তু না সেরকম কোন কিছুই জুটল না বরং এক তাচ্ছিল্য 
  
‘দূর দূর এসব কোন কবিতাই হয়নি , কিস্যু হয়নি। কবিতা লেখা খুব সহজ কাজ নয় রে মোহিনী । এইসব ছোটখাটো কাগজ । সম্পাদকদের কোন জ্ঞানগম্যিই নেই।তুই যদি কোনদিন ভারতবর্ষ পত্রিকায় লিখতে পারিস। তোকে আমি একবাক্যে কবি বলে মেনে নেব ভাই । এসব কাগজের কোন মান নেই যে কেউই  যখন খুশি লিখতে পারে তাহলে তো সবাইকেই একবাক্যে কবি বলে মেনে নিতে হয় ?
দ্বিজেন্দ্রলাল রায় প্রতিষ্ঠিত ভারতবর্ষ পত্রিকা তখন বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল দিগন্তসাহিত্যের রত্নভাণ্ডার ।জলধর সেনের সুসম্পদনায় তা  আরও উৎকৃষ্ট হয়ে ওঠে এবং সাহিত্য অনুরাগী মানুষের কাছে বিশেষ সমাদর লাভ করে কি নেই নেই এখানে গল্প উপন্যাস থেকে আরম্ভ করে সাহিত্যের নানা শাখা প্রশাখা ।  নামী দামী কবি সাহিত্যিকদের লেখায় ভর্তি এক একটা নাম উচ্চারণ করলে গায়ে শিহরণ জাগেপ্রবোধকুমার সান্যাল,শৈলবালা ঘোষজায়া, বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়,অনুরূপা দেবী, নিরুপমা দেবী,নরেন্দ্র দেব, রাধারানী দেবী ,উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় , দিলীপকুমার রায়,স্বর্ণকমল  ভট্টাচার্য,শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথ , শরৎচন্দ্রের বিখ্যাত উপন্যাসগুলি  ভারতবর্ষের পাতাতেই প্রকাশিত তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের গণদেবতা ,   মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুতুলনাচের ইতিকথা  ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল ভারতবর্ষের পাতায়
পত্র পত্রিকাগুলো গুছিয়ে রাখতে রাখতে বাবা বললেনকিছুই হয়নি বলছো ? এত পরিশ্রম
- সব পণ্ডশ্রম একদম কিস্যু হয়নি হিম্মত থাকে তো ভারতবর্ষে লিখে দেখা প্রবাসীতে লিখে দেখা  
কবিতা লেখা চললেও মনে সেরকম শান্তি নেই তখন এক অদ্ভুত অতৃপ্তি কুরে কুরে খাচ্ছে বাবার  মন ভারতবর্ষে লিখতেই হবেকেন ? আমি তো নিজের আনন্দে লিখিভাল লাগে বলে লিখিচারপাশে রক্ত গরম দেওয়া বিষয়গুলো যা মাথার ভেতর কিলবিল কিলবিল করে আর শব্দের আশ্রয় নিতে চায়কখনও স্বতস্ফুর্ত লাভাস্রোতের মতো বেরিয়ে আসেকবিতা তো এটাইনা কি তার আশ্রয়ই বড় কথা এসব টানাপড়েন চলে বাবার  মধ্যে এরকমভাবে বেশ কিছুদিন কাটল চঞ্চলতায় তারপর একদিন  রাতে বেশ কয়েকটি কবিতা লিখে ফেললেন পরদিন সকালেই ভারতবর্ষ পত্রিকার দপ্তরে সেই কবিতাগুলি  বাবা পাঠিয়ে দিলেন ডাকে তখন ভারতবর্ষ পত্রিকার সম্পাদক ফনীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় এবং শৈলেনকুমার চট্টোপাধ্যায় গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এন্ড সন্স এর পক্ষে কুমারেশ ভট্টাচার্য প্রকাশক ২০৩//১ বিধান সরনী, কলকাতা ৬ থেকে প্রকাশিত হত পত্রিকাটি দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও কোন উত্তর না আসায় বাবা একরকম হতাশএরকম পরিস্থিতির ভেতরেই প্রায় ছমাস পর ডাকে এল ভারতবর্ষ পত্রিকার কপি লেখা ছাপা হলভারতবর্ষ পত্রিকায় কিংবদন্তী সেইসব কবি লেখকদের নামের পাশে নিজের নাম জ্বলজ্বল করে মুদ্রিত হয়ে আছে দেখেও কোন আবেগের বুদবুদ তৈরি হল না মনে   কোন  অতিরিক্ত আনন্দও হল নাবরং আকাশ দেখএই কবিতাটি ছাপা হয়েছে শ্রী মোহিনীমোহন গাঙ্গুলী নামেবাবা তখন মোহিনীমোহন গাঙ্গুলী নামেই লিখতেন পরে সাতের দশক থেকে গঙ্গোপাধ্যায় লিখতে শুরু করেনসেকথা ধীরে ধীরে আসবে  পত্রিকার কপি সেদিনই ডাকে এসেছে সদ্যএকটা বাজি জিতে যাওয়ার বেশি কিছু নয়যার সাথে সেই বাজি তাকে না দেখালে তো মনে শান্তি আসবেকোন কাজে স্থিরতা আসবে না সবসময় ছটফট করছে মন
দাদু বললেনযা মেজদাকে দেখিয়ে আয়
আমার মেজদাদু  আশীর্বাদ করলেন প্রাণ করে
কিন্তু এতেও শান্তি নেই যে মানুষটির সাথে এই বাজি ধরা তাঁকে না দেখালে তো মন থেকে চঞ্চলতা দূর হবে না কোনোমতেই
 নাওয়া খাওয়া ভুলে তখনই একছুট কৃষ্ণপদ ভট্টাচার্যের বাড়িসবেমাত্র স্নান করে তিনি তখন  নিত্যপূজায় ব্যস্তমন্ত্রগুলি ভেসে আসছে বাতাসে এখনও অনেক দেরি হবে পুজার্চনা সাঙ্গ হতে কিন্তু তা হল না বাবার পায়ের শব্দে পুজা সংক্ষিপ্ত রেখেই তিনি বেরিয়ে এলেনএসেছিস ভাইটি বল কি খবর ?   
 এই দেখো , কৃষ্ণদা আমার কবিতা বেরিয়েছে  ভারতবর্ষে  
কই , কই দেখি প্রবল আগ্রহে এগিয়ে এলেন তিনি ডাঁটভাঙা চশমটা কোনরকমে তুলে নিলে নাকের ডগায় প্রত্যেকটি পাতা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়লেন তারপর বাবার কবিতার কাছে এসে আরও নিবিড় হয়ে এল তার দৃষ্টিবড় সুন্দর লিখেছিস তো কবিতাটি কত নক্ষত্র তার মাঝে তুইও আছিস আয় তোর মাথায় হাত রাখি
তার চোখে জল বাস্প জমছে চশমায়- আমার সারা জীবনের সাধ ছিল ভারতবর্ষের পাতায় লেখার পারিনি খুব অল্প বয়সেই তুই পেরেছিস এটাই আমার জয় এবার তোকে প্রবাসীতে লিখতে হবে
-       তা হয়তো লিখব কিন্তু আর কোন চ্যালেঞ্জ নয় দাদা চ্যালেঞ্জ এটাই হোক মানুষের কবিতাই যেন লিখতে পারি  তোমাদের আশীর্বাদে
                                                                                       (ক্রমশ)
  
      

        

1 comment:

  1. ভাল । পরবর্তীর অপেক্ষা...

    ReplyDelete