।। বাক্‌ ১২০।। পার্থজিৎ চন্দ ।।








বাংলা কবিতায়, বা শুধু বাংলা কবিতাতেই বা বলি কেন, যে কোনও ভাষার কবিতাতেই দু-একটি অস্বস্তি-জাগানো নাম থাকে বাংলা কবিতায় সেই রকম একটি অস্বস্তি উদ্রেককারী নাম নিঃসন্দেহে উৎপলকুমার বসু
       উৎপলকুমার ভয়ংকর ভাবে বানিজ্যসফল নন তাঁর কাব্যগ্রন্থ কবিতা- থেকে-আট মাইল দূরে-থাকা তরূণ বা তরূণী বালিশের নিচে রেখে নিদ্রা গেছে, এই অপবাদ কেউই দিতে পারবে না তিনি জনপ্রিয় কবি হয়ে ওঠেন নি; আবার এক অংশের পাঠকের কাছে তিনি অসামান্য শ্রদ্ধা (শুধু মাত্র তাঁর কবিতার জন্যই) পেয়ে এসেছেন এবং  মৃত্যুর পরেও পাঠকের কাছে তার কবিতার যে গোপন সঞ্চারণ ঘটেই চলেছে তা তো স্পষ্টতই দৃশ্যমান তিনি একদা হাংরি সঙ্গ করেছিলেন চাকরী খুইয়ে বিদেশে চলে যান সেখানে আর্থিক কষ্ট মেটে তাঁর কবিতা থেকে দূরে থাকেন কিন্তু বাংলায় ফিরে এসে তিনি আশ্চর্যজনকভাবে ফিরেও পান তাঁর ফেলে যাওয়া উষ্ণীষ প্রতিষ্ঠান নিয়ে তিনি একাডেমিকভাবে যা, প্র্যাক্টিসের ক্ষেত্রে সেই প্যারামিটার মেনে চলেননি ফলে উৎপলকে নিয়ে ঘনিয়ে উঠেছে নানাবিধপ্যাঁচ
       উৎপলের কবিতা নিয়ে কিছু কথা বলার আগে এটিও জানিয়ে রাখা ভালো, উৎপল আমার প্রিয়তম কবিদের মধ্যে আসন পেতে বসেননি কোনও দিন ভবিষ্যতেও সে সম্ভাবনা নেই বলেই মনে হয় বাংলা কবিতা পাঠকদের বেশীরভাগ ক্ষেত্রে একটা মুদ্রাদোষ লক্ষ্য করা যায় যে কবি বা কবিদের কবিতা তাদের আকর্ষণ করে, সেই লিখনভঙ্গীমার বাইরে অবস্থানকারী কবি- সাহিত্যিকদের লেখালিখির দিকে তারা ছুঁড়ে দিতে পছন্দ করেন এক ধরণের উদাসীনতা এই প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসা জরুরী উৎপল আমার প্রিয়তম কবি নন, কিন্তু এটিও অনস্বীকার্য যে উৎপল বাংলা কবিতার ভিতরে ঠেসে দিতে পেরেছিলেন এক বিশেষ অ্যনার্কিজম ভাষাকে আক্রমণ করে তার ভিতরে ঘনিয়ে ওঠাপঞ্চাশের লৌহমলকে খসিয়ে দিয়েছিলেন বেশ কিছুটা বেশ কিছুটাই বললাম, কারণ উৎপল যা করতে পারতেন তা পূর্ণমাত্রায় করেননি তিনি পেরেছিলেন অনেকটাই এটা বিশ্বাসযোগ্য নয় যে তিনি পরের কাজটুকু পারতেন না কিন্তু তিনি করেননি, এটিও সত্যি সে প্রসঙ্গে পরে আসা যাবে

       আমার মতে উৎপলের সব থেকে বড় সাফল্য, তিনি বাংলা-কবিতা লিখিত হবার যেঅ্যকসেপ্টেড প্যাটার্ণ’, সেটিকে অনেকটাই দুমড়ে-মুচড়ে দিয়েছিলেন নিপুন দক্ষতায় নিরানব্বই শতাংশ বাংলা কবিতাই লিখিত হয় অ্যসেন্ডিং অর্ডারে এক্ষেত্রে ছোটগল্প লিখিত হবার বহু-প্রচলিত ধারণাই প্রনোদনা হিসাবে কাজ করে যায় পাঠক মনে মনে একটি গ্রাফ কল্পণা করলেই বুঝতে পারবেন বাংলা কবিতার প্যা্ট্যার্ণ পিরামিড-সদৃশ অর্থাৎবেসস্থাপনের পর তা ক্রমশ ছূঁচালো হয়ে ঊর্ধবিন্দু সৃষ্টি করতে সচেষ্ট কিন্তু উৎপলকুমার এই বেসকে ভেঙ্গে দিয়ে বেশ কিছুটা রিভার্স পিরামিডের আকার দিলেন তাঁর কবিতায় যে গতিজাড্যের অনুভূতি সেটার মুখ্য কারন এটিই উৎপল পরীক্ষাপর্যবেক্ষণসিদ্ধান্তের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা এক অস্তিত্ব আলস্যভরা মেধা ও তুখোড় নির্মাণ দক্ষ
হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে উৎপল নিজেকে একটা সময়ে যতটাই যুক্ত করুন না কেন, সেই আন্দোলনের প্রতি উৎপলের নীতিগত সমর্থণ থাকলেও নিজের কবিতাকে তিনি সেই ধারায় প্রবাহিত হতে দেননি তাঁর মনোজগতে নিহিলিজম ও অ্যনার্কিজমের একটি ছায়া ঘন হয়ে ছিল কিন্তু তিনি যে ইডিওলেক্ট অর্জণ করলেন তার মধ্যে মিশে আছে ট্র্যাডিশনার স্বরের সঙ্গে ভাঙচুরের এক সূক্ষ মেলবন্ধন অতি সূক্ষ ব্লেন্ডিং এই ইডিওলেক্টের মধ্যে মিশে আছে শব্দ ও চিন্তনের জাক্সটাপজিশন উৎপলের কবিতার দিকে তাকালেই বোঝা যাবে তিনি একটি শব্দের পাশে অতর্কিতে সম্পূর্ণ অন্য শব্দ স্থাপন করছেন পাঠক সেই শব্দটিকে আশা করেননি এই প্রতিস্থাপন বেশ রহস্যময় ও মেধাবী এক বুবিট্র্যাপ তৈরী করে উৎপল নিজের সম্পর্কে একদা ঘোষনা করেছিলেন, ‘এখানে বললে হয়তো দুর্বিনীতের মতো শোনাবে, বাংলা কবিতায় সিনট্যাক্স ভাঙার ব্যাপারটা আমিই প্রথম করেছি সিনট্যাক্স না ভাঙলে ভাষার চিন্তার গভীরে যাওয়া খুব মুশকিল –‘ তাঁর এই কথার সঙ্গে দ্বিমত পোষন করবার খুব একটা অবকাশ নেই কিন্তু এই সিনট্যাক্স ভাঙবার কাজটির ভিতরে তাকালে এটাও ধরা পড়ে যে উৎপল সেই পথে অবিচল থাকেননি বারবার তাঁর যাতায়াত ঘটেছে এই ভাঙচুর আর আবহমান ধ্রুপদী পাট্যার্ণের মধ্যে তাঁর সারা জীবনের কবিতার দিকে তাকালে দেখা যাবে পাঠকের কাছে এটিই উৎপলের কবিতাকেন্দ্রিক প্রধাণতম প্যাঁচ হয়ে রয়ে গেছেবক্সীগঞ্জে পদ্মাপারে’ ‘কহবতীর নাচতো আকীর্ণ হয়ে আছে সেই লেখায় যেখানে উৎপলের এই সিনট্যাক্স ভাঙবার কাজ অনুপস্থিত এগুলি যদিও বেশ পরের দিকে লেখা তাহলে এটা কি ধরে নিতে হবে যে উৎপল একটি নির্দিষ্ট সময় পরে তাঁর এই ভাঙচুর করার পথ থেকে সরে এসেছিলেন? না, তা নয় উৎপলের কবিতায় এই প্রবণতা কিন্তু ছিলই সেই প্রথম দিন থেকেই ছিলচৈত্রে রচিত কবিতার কথা বাদ দিলেও , ‘আবার পুরী সিরিজ’ ‘লোচনদাস কারিগরএই একই চিহ্ন বহন করে চলেছে
আসলে উৎপল একই সঙ্গে বেশ কয়েক ধরণের কবিতা লিখেছেন তাঁর ভাঙচুরের দিকে, সিনট্যাক্সের দিকে আমরা এতটাই নজর দিই যে অন্য ধারায় লেখা কবিতাগুলি সম্ভবত আমাদের চোখ এড়িয়ে যায় একজন লেখকের সারা জীবনের লেখালিখি থেকে কয়েকটি লেখা বিক্ষিপ্তভাবে উল্লেখ করলে হয়তোজাস্টিসকরা হয় না , তবুও আসুন দুএকটি লেখার দিকে চোখ ফেরাই,
অতসী দূর্বল তবু লোক-অপবাদে
পথের দুপাশে কেন চেঁচায় স্বৈরিণী?
আমি নিস্পৃহ চলে যাই অন্য সকলেও
কোনো ভ্রান্ত কবি দূর থেকে দ্যাখে সব

অগ্নিরেখা আমাদের সমর্পিত কোল ঘেঁষে
তুমি উৎসব ফুরালে ঐ কাচপাত্র ধুয়ে রাখো
আবর্জনা অতীতের বলে নামি, ‘হায় রে মায়াবী
লন্ঠন জ্বালালে কেন? সকলেই অন্য নিমন্ত্রণে চলে গেছে’ (জন্মদিন)
চৈত্রে রচিত কবিতা-র এই লেখাটির সঙ্গেই আছেরাজার মত রাজাবা মুখে মুখে ঘোরানবধারাজলেকবিতাও,
মন মানে না বৃষ্টি হলো এত
সমস্ত রার ডুবো-নদীর পারে
আমি তোমার স্বপ্নে-পাওয়া আঙুল
স্পর্শ করি জলের অধিকারে
পুরী সিরিজ’-এর দীর্ঘ লেখাফেরিঘাট’-এ জীবনানন্দের ছায়া দীর্ঘ হয়ে আছে আছে একের পর এক অতর্কিত ইমেজারি কিন্তু সিনট্যাক্স সেখানেও ভাঙেননি উৎপল খন্ডবৈচিত্রের দিন-এ গূঢ কথন আছে উৎপল যে ভাবে পাঠককে পাহাড়চূড়া থেকে উপত্যকা , উপত্যকা থেকে পাহাড়চূড়ায় ছুটিয়ে নিয়ে যেতে পছন্দ করেন সেই প্রবনতা এই বইয়ে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত  উৎপলের কবিতা সম্পর্কে কথা উঠলেই যে সিনট্যাক্স ভাঙবার কথা উঠে আসে, সেটি পাওয়া যায় না এখানে
ঠিক এই কারণেই এই লেখার একদম প্রথমেই স্পষ্ট ভাবে ব্যাক্ত করেছিলাম, উৎপল অনেকটাই খসিয়ে দিয়েছিলেন লৌহমল পুরোটা করেননি ডেলিবারেটলিই করেননি কারণ শুধু আইকনোক্লাস্টের ভূমিকায় নিজেকে তিনি আবদ্ধ রাখতে চাননি হয়তো সে তিনি নিজে যতই প্রতিপন্ন  করবার চেষ্টা করুন সেই ভূমিকাকে

উৎপলকুমার মারা যাবার পরপরই তাঁর বন্ধু শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়ের একটি ‘অদ্ভুতুড়ে’ উৎকট-যুক্তি সম্বলিত লেখা পড়েছিলাম। শরৎকুমার লিখছেন, ‘পুরী সিরিজ-এর কথা বলি। এই বইটা থেকেই তো ওর খ্যাতি। যে শব্দের পাশে যে শব্দ মানায় না সেগুলো গেঁথে এক ধরণের রহস্যময়তা তৈরির চেষ্টা। বাদামপাহাড় বলে কিছু হয় কিনা আমার জানা নেই। তো সেই বাদামপাহাড়ে কেন বসন্ত দিনের চটি হারিয়ে যাবে আমি বুঝতে পারি না। তরুন কবিরা ওর এই দুর্বোধ্যতায় বেশ আকৃষ্ট হল। ... ‘ও শ্বেত বৈধব্য, পাখি,তুমি কারাগার – এর মানে কী? আমার মাথায় ঢোকেনি’ (উৎপলকুমার সম্পর্কে আমার ধারণা)।
যে শব্দের পাশে যে শব্দ মানায় না – এইটুকু হয়তো শরৎকুমার ঠিকই বলেছেন। ‘মানায় না’ , এর থেকে বলা সঙ্গত যে আমাদের চিন্তন-পদ্ধতি যে শব্দের পাশে যে শব্দটিকে অনুমান পর্যন্ত করে না, সেটিকেই ব্যবহার করেছেন তিনি। উৎপলের লেখার সব থেকে বড় দস্তখত লুকিয়ে থাকে সেখানে। কিন্তু বাঙ্গালী পাঠককূল ও কবিদের একটি বড় অংশও যে কবিতা লেখার ক্ষেত্রে দৈব-প্রেরণা ও একরৈখিক চলনকেই বেশী গুরুত্ব দেন এই লেখাটি পড়লে সেটাও স্বচ্ছ হয়ে আসে। উৎপল সার্থকভাবে ব্যবহার করতে পেরেছিলেন তাঁর মেধাকে। কবিতার শরীরে তিনি বুনে দিতে পেরেছিলেন চৈতণ্যপ্রবাহ, শ্লেষ ও তীর্যক-কৌতুকময় দেখাকে। শরতকুমারের মত অনেকের কাছেই সেগুলিকে মনে হল নিছক চালাকি। ২০১৭ সালে যেমন, ঠিক তেমনই বাংলা লিরিসিজমের একটা আবেদন সেই সময়ে আরও তীব্র ছি্ল পাঠকের কাছে। সে পাঠক কতটা ‘কবিতা’র পাঠক সে নিয়ে তর্ক থাক আপাতত। এই পরিসরের বাইরে বেরিয়ে অনেকেই বাংলা কবিতার এই প্রবণতাকে আক্রমণ করেছেন। এমনকি দায়িত্ব নিয়ে বলা যায়, উৎপলের থেকেই বেশী মাত্রায় আক্রমণ করেছেন কেউ কেউ। আবার এটাও স্বচ্ছন্দে বলা যায় এই লিরিসিজমের ছদ্ম-মায়াভরা কবিতার থেকেও বেশী নিকৃষ্ট কবিতা লিখেছেন তাদের বেশীরভাগই। কারণ কামানের মুখে ঢাল-তলোয়ারহীন নিধীরাম সর্দ্দারের মত ছুটে যাবার মধ্যে হটকারিতা থাকতে পারে। রণকৌশল না থাকলে, অফুরন্ত রসদ না নিয়ে যুদ্ধে নামলে পরাজয় নিশ্চিত। লক্ষণরেখার বাইরে বেরিয়ে কবিতা লেখা কোনও দিনই সহজ কাজ নয়। এবং ট্র্যাজিক-পতনের গৌরবটুকুও দেওয়া যায় না সবাইকে।
       উৎপল এখানেও জিতে গেলেন। সিনট্যাক্স ভেঙে তিনি যা লিখলেন সেই কবিতাকে একটু সরিয়ে রেখে দেখলে দেখা যাবে, ট্র্যাডিশনাল ঘরাণার মধ্যেও তিনি তৈরী করে নিতে পেরেছিলেন আলাদা একটা পরিসর। সেই লেখাগুলি যখন লিখলেন তখনও তিনি এতটাই সার্থকভাবে ক্যামোফ্লেজ করতে পারলেন যে লেখাগুলিকে আমাদের মনে হয় অন্যগ্রহের কবিতা। এই ক্যামোফ্লেজ কিছুতেই চালাকি নয়। মেধা ও আবেগের সৎ ব্যাবহার।অতি- চেনা অনুসঙ্গ ত্যাগ করে তিনি কবিতাই এনে বসালেন পাথরের চোখ-নিয়ে-জেগে থাকা সুন্দরকে। অনন্ত জড় জগতকেও তিনি লেখায় টেনে আনলেন। ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে রইলেন। অটোমেটিক-রাইটিং’কে ছুঁড়ে ফেলেদিলেন আটলান্টিকে। ক্রিপ্টিক –নোটস হয়ে উঠল তাঁর লেখা। এক-দু মাত্রা পেরিয়ে পড়তে হয় তাঁর লেখা।

       এই কারণেই , উৎপল গত তিনটি দশকের নিরিখে বাংলা কবিতা লিখতে আসা তরুনদের কাছে সব থেকে বড় ইনফ্লুয়েন্স। প্রকাশ্যে অনেকেই স্বীকার করেন না, কিন্তু তাদের লেখার দিকে তাকালেই ফুটে ওঠে পঞ্চাশের অন্য কবিদের থেকে উৎপলের প্রভাব এই সময়ে অনেকবেশী। উৎপলের ভাষা-ব্যবহার সময়ের থেকে এগিয়ে ছিল। উৎপল ভাষাকে আক্রমণ করেছেন। ভাষার চলিত কাঠামোর মধ্যে দাঁড়িয়েও ক্যামোফ্লেজ করেছেন, কৌতুক করেছেন। কিন্তু যা করেছেন উদ্দেশ্যপ্রনোদিত ভাবেই করেছেন। মেধা ও মননকে অনবরত শান দিয়ে গেছেন অভ্যাসে বিবাহের গান লেখেননি তিনি
       শুধু একটা অদ্ভুত আক্ষেপ আজকাল গ্রাস করে ঘন-জঙ্গল, শ্বাপদ-ডাকা পথযে পথে বাঙালী কবিদের বড় কেউ একটা পা বাড়াতে চান না, সেই পথে উৎপল অনেকদূর পর্যন্ত হেঁটে গেলেন তারপরই যেন একটা সেলফ-রেসট্রিক্সন যা করতে পারতেন তার অনেকটাই করলেনশুধু কী-এক অজ্ঞাত কারণে পূর্ণমাত্রার থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে রইলেন
এই আক্ষেপটুকুও যে তাঁর মত উচ্চতাসম্পন্ন কবির ক্ষেত্রেই করা যায়  

No comments:

Post a Comment