বৃষ্টিকে কেউ চিঠি লেখে না
এই দু-বছরে
এসব বৃষ্টির গা সয়ে যাওয়ারই কথা। পুজোর পর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিন সকালেই
বাপির সঙ্গে তার বাবার এসব চলে। একপ্রস্থ কথাকাটাকাটি। মুখভার। তারপর দুজনেই
বেরিয়ে যায়। ফিরে এসে দুপুরে ভাত খেতে বসে আবার একরকম মিটমাট হয়ে যায়। কোনো বিকেলে
বাপি চুপিচুপি বেরিয়ে গেলে রাত্তিরে ফেরার পর আবার গোলমাল। এই কয়েক মাস দুজনের
মধ্যে সম্পর্কটা সহজ হয় না। সেটা হয় মোরগ লড়াইয়ের সিজনটা পেরিয়ে গেলে। তখন আবার
বাপ-ছেলে পাশাপাশি বসে কোল্ড স্টোরে আলু রাখা নিয়ে আলোচনা করে, গ্রামের রাজনীতি
নিয়ে আড্ডা দেয়, সংসারের ভবিষ্যৎ নিয়ে পরিকল্পনা করে। বাপির
মা তখন গিয়ে দুজনের মধ্যে বসার ভরসা পায়। এই কয়েকমাস সেটা হওয়া মুশকিল।
দু-বছরেই
বৃষ্টি বুঝে নিয়েছে। অনেক রাগ এবং চোখের জলের ব্যর্থ পর্ব এর মধ্যে এসেছে তার। এখন
আর গায়ে লাগে না।
জগন্নাথ
প্রতিহারের ছেলে বাপি প্রতিহারের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে। জিরাপাড়া
গ্রামে বাপির মোরগ লড়াইয়ের শখ সবচেয়ে বেশি। এই গ্রামে বেশির ভাগ লোকই বাড়িতে
দু-একটা লড়াইয়ের মোরগ পোষে। কিন্তু বাপির ক্ষেত্রে এটা ধ্যানজ্ঞান হয়ে দাঁড়িয়েছে
ছেলেবেলা থেকে। সে দূরদূরান্ত থেকে দুর্দান্ত সব মোরগ সংগ্রহ করে আনে। নিয়মিত খবর
রাখে কোথায় লড়াকু মোরগ এসেছে, কোথায় একটা লড়াইয়ের আসর জমবে। এই নিয়ে চোদ্দ-পনের
বছর বয়স থেকেই বাপের সঙ্গে তার ঝামেলাও চলছে।
আসলে
জিরাপাড়া গ্রামে জগন্নাথ প্রতিহারই একমাত্র লোক যার মোরগ লড়াইয়ের প্রতি কোনো
আকর্ষণ কোনোকালেই নেই। এই নেশা কাটানোর জন্য জগন্নাথ একমাত্র ছেলেকে লরি চালানোর
কাজে লাগিয়ে দিয়েছিলেন, তার মায়ের অনেক আপত্তি সত্ত্বেও। বাপি প্রায় বছর দশেক
লাগাতার লরি চালিয়েছে। প্রথমে ক্লিনার, পরে ড্রাইভার হিসেবে কাশ্মীর থেকে
কন্যাকুমারী তার ঘোরা হয়ে গেছে, কখনও পটল কখনও পাথর কখনও আঙুর বোঝাই লরি নিয়ে। কিন্তু
একটা দুর্ঘটনার পরে তার মা আর লরি চালাতে দিল না। এখন বাপি নিজেই একটা লরি কিনেছে।
একজন ড্রাইভার রেখেছে। আরেকটা লরি কেনার খুব ইচ্ছে, সেটা হয়েও যেত, কিন্তু গত
মরসুমে স্টোরে আলু রেখে প্রায় দু-লাখ টাকা লোকসান হওয়ায় পিছিয়ে যেতে হয়েছে।
এরমধ্যে
বাপির বিয়ে দেওয়া হয়ে গেছে। বৃষ্টি। সদ্য মাধ্যমিক ফেল। আইনসম্মত
বিয়ের বয়স বৃষ্টির হয়নি। কিন্তু এই বন্য এলাকায় মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার সময় কেউ আইন
দেখে না। দু-বছর বিয়ে হয়েছে। এখনও তার বয়স আঠারো পেরোয়নি। অবিশ্যি এত সুন্দরী
মেয়েও এই তল্লাটে কেউ কোনোকালে দেখেনি। আনা হয়েছে শালবনী থেকে। গরীব বাপের মেয়ে,
বাপ বাসের কন্ডাক্টর, একটা পয়সাও পন নেননি জগন্নাথ, বরং নিজেই কিছু খরচ করেছিলেন।
বৃষ্টি
বরের খুব ন্যাওটা হওয়ার চেষ্টাই করেছে। তার সমবয়সী
কেউ আশেপাশে নেই। বরও তার চেয়ে প্রায় সতের-আঠার বছরের বড়ো। কিন্তু তবু ভাব করতে
চেয়েছে। গায়ে গায়ে ঘুরেছে। খবরদারি
করার চেষ্টা করেছে। মোরগের ব্যাপারেও আগ্রহ দেখিয়েছে। বাপি
খুব একটা পাত্তা দেয়নি। বরং সরিয়ে দিতেই চেয়েছে। রাত্তির
ছাড়া বৌকে নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। বিয়ের পর থেকে আজ অবধি বাপি একবারও
শ্বশুরবাড়ি যায়নি। বৃষ্টি জেদ ধরে বার দুয়েক গেছে। জগন্নাথ নিয়ে গিয়েছিলেন। বৃষ্টি
নিজে ফিরে এসেছে।
লরি
ছেড়ে আসার পর বাপি আবার পুরোপুরি মেতে গেছে মোরগ লড়াই নিয়ে। এই কয়েকটা মাস সে আর
কোনোদিকে মন দিতে পারবে না। আবার শুরু হয়েছে বাপ-ছেলের ঝামেলা।
মোরগ
লড়াই আদৌ সোজা ব্যাপার নয়। তার মধ্যে অনেক সাধ্যসাধনার সুযোগ আছে। মোরগগুলোর দামও
কম নয়। চারশো থেকে চার হাজার অবধি দাম হতে পারে, সেটা আকার এবং প্রকারের উপরে
নির্ভর করে। তাদের পরিচর্যা করাটাও কম ঝক্কি নয়। মোরগের শরীরের মতোই তার মনের
দিকেও নজর রাখতে হয়। একটা মোরগকে লড়াইয়ের জন্য তৈরি করতে হলে তাকে আর পাঁচটা
মোরগ-মুরগির সঙ্গে মিশতে দেওয়া চলে না। একটা ঘুপচি অন্ধকার ঘরে রাখতে হয়। পুষ্টিকর
খাবার খাওয়াতে হয়। মোরগ যে দুধ খায়, বৃষ্টি শ্বশুরবাড়িতে এসেই প্রথম দেখেছে।
দেখেছে মোরগকে নিয়মিত লবঙ্গ খাওয়ানো হচ্ছে, মরা বোলতা খাওয়ানো হচ্ছে, সে খেতে
চাইছে না, ঠোঁট ফাঁক করে মুখে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বৃষ্টির ভয় হত, মোরগটার দম আটকে
যাবে না তো! তার এক মামা গলায় মাংসের হাড় আটকে মরে গিয়েছিল।
লবঙ্গ
আর বোলতা খাওয়ালে মোরগের রাগ বাড়ে। আরো
তেড়েফুঁড়ে লড়াইটা করে।
কয়েকমাস
হল বাপি এক শাগরেদ জুটিয়েছে। সতের-আঠারো বছরের একটি আদিবাসী ছেলে। নাম হ্যান্ডেল। হ্যান্ডেলেরও
জীবনে একমাত্র নেশা মোরগ লড়াই। বাপির সঙ্গে পুরোদস্তুর জমে গেছে তার।
বৃষ্টি
তো ভাবে বাপি হ্যান্ডেলকেই বিয়ে করলে পারত।
আজ খুব
সকালেই দরজার কড়া নড়ল। তখনও রোদ পড়েনি উঠোনের আমগাছে। পায়খানা থেকে তাড়াতাড়ি
বেরিয়ে বৃষ্টিই বাসিমুখে দরজা খুলল। হ্যান্ডেল এসেছে।
জগন্নাথ
আজও দাঁতন করেন, টুথপেস্ট তাঁর সয় না। হ্যান্ডেলকে দেখেই বললেন, ‘এসে গেছে স্যাঙ্গাৎ
! তার মানে আজ বিকালেও লড়াই করতে যাবেক। কী রে?’
হ্যান্ডেল
এ বাড়ির রকমসকম জানে। সে কোনো উত্তর দিল না।
বাপি
বেরিয়ে এসেছে। সে বলল,‘যেতেই পারি। রোজ-রোজ কেন একই কথা বলো ? এই বৃষ্টি,
হ্যান্ডেলের জন্যে চা কর। আমার জন্যেও। আমরা বেরাব।’
এই
তুইতোকারির অভ্যাসটা বৃষ্টি সইতে পারে না। বিশেষ করে লোকের সামনে।
সে থমথমে
মুখে কলতলায় গেল, দ্রুত দাঁত ব্রাশ করতে লাগল।
জগন্নাথ
যথারীতি মুখে দাঁতন নিয়ে বকবক করছিলেন। তাঁর আসল ব্যাপারটা খেয়াল নেই দেখে বাপির
মা বললেন, ‘আজ বিকালে সত্যিই লড়াইয়ে যাবি নাকি বাপি?’
বাপি
গোঁজ হয়ে বলল, ‘হ্যা। যাব তো বটেই। ক্যানে?’
‘আরে
তোর বাপ আর আমি যে আজ থাকবোনি! তোর মামার শরীর খারাপ, বললম নি তোকে কাল? দেখতে
যেতে হবেক তো! তুই তো যাবিনি। আমাদেরকেই যেতে হবেক।’
‘যাও।
আমি কি বারন করেছি?’
‘বৌমা
কি ঘরে একলা থাকবেক?’
এবার
সত্যিই একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে তাকে নিয়ে, বৃষ্টি বুঝল। সে বলল, ‘আমাকে নিয়ে
কাউকে ভাবতে হবেনি।’ মাধ্যমিক অবধি পড়ার দৌলতে সে ‘লিয়ে’-টাকে ‘নিয়ে’ বলল, কিন্তু
‘হবে নি’-কে ‘হবে না’ বলতে বৃষ্টির লজ্জা করল। এমনিতেই
তার ‘শিক্ষিতপনায়’ শ্বশুরবাড়ির লোক হাসিঠাট্টা করে।
বাপি
বৌকে ধমক দিল, ‘তুই চুপ মার। তোকে কে ডাইলগ দিতে বলেছে?’
প্রথমের
দিকে কেঁদে-টেঁদে ফেলত, এখন আর কারো কথা বৃষ্টির গায়ে লাগে না। সে নির্বিকারে মুখ
ধুতে শুরু করল।
একটা
ঝামেলা কিন্তু সত্যিই পাকিয়ে উঠল।
আজ
এখান থেকে বেশ কিছুটা দূরের একটা গ্রামে লড়াই হবে। বিরাট আসর। এই লড়াইটার জন্য গত
কয়েকমাস ধরে বাপি তার একটা দামি মোরগকে তৈরি করছে। না যেতে পারলে তার মাথায় খুন
চেপে যাবে, সবাই বুঝতেই পারছে। তবু জগন্নাথ বললেন, ‘কী হবেক আজকেও যেয়ে? একটা দিন
থাউ না ক্যানে? এত তো জিতলি! রোজই তো মাংস হচ্ছে ঘরে! খেয়ে খেয়ে সবাই তো আলা হয়ে
গেল।’
সত্যিই
সবাই মাংস খেয়ে খেয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে এই কয়েকদিনে। সপ্তাহে অন্তত চার-পাঁচদিন
বাপি লড়াইয়ে যাচ্ছে। পরাজিত বা মৃত মোরগকে বাইকে ঝুলিয়ে ঘরে ফিরছে। একাধিক জিতলে
রাস্তায় একটা-দুটো দান করে আসছে। প্রায় রোজ রাতেই মাংস। আর কেউ খেতে চাইছে না।
বাপির নিজেরই পেটে গোলমাল শুরু হয়েছে।
কিন্তু
বাপি বলল, ‘মাংস খাওয়াটা বড়ো কথা লয় বাবা। তমাকে আজও
বুঝাতে পারলমনি, জিতাটাই বড়ো কথা। মাংস লয় অন্য কাউকে দিয়ে দুব। না রাঁধলেই হল।’
জগন্নাথ
চেষ্টা করেই জোরের সঙ্গে বললেন, ‘আজকের দিনটা থাউ।
তরাও আমাদের সঙ্গে চ, মামাকে দেখে এসবি। তারা খুশি হবে।’
‘আমার
দরকার নাই। তমাদের বৌমাকে লিয়ে যাও।’
জগন্নাথ
কিছু বলার আগেই মুখের জল ফেলে বৃষ্টি বলল, ‘আমি যাবনি।’
সে
দ্রুত পায়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল।
বাপি
পেছন থেকে রুক্ষ গলায় বলল, ‘তোর আবার খুব ঝাঁজ বেড়েছে আজকাল...’
উত্তর
এল, ‘হ্যা। বোলতা ধরে ধরে খাচ্ছি কিনা খুব।’
হ্যান্ডেল
হেসে উঠল। এইসব কথা কাটাকাটির মধ্যে সে বাপির কানে বলে দিল আজ সে লড়াইয়ে যেতে
পারবে না। চাষের একটা কাজ পড়ে গেছে। সেটাই সে বলতে এসেছে।
বাপি
অবাক হয়ে গেল।
এমন
প্রতীক্ষার লড়াই হ্যান্ডেল ছেড়ে দিচ্ছে !
কিন্তু
গোলমালের মধ্যেই হ্যান্ডেল প্রতিহারদের বাড়ি থেকে চুপচাপ বেরিয়ে পড়ল। চা-ও খেল না।
হ্যান্ডেল।
হ্যান্ডেল হেমব্রম।
তার
নাম হ্যান্ডেল কেন, কেউ জিজ্ঞাসা করে না, কারন এ এলাকায় আদিবাসীদের মধ্যে এরকম
অদ্ভুত নাম দেওয়ার চল আছে। কারো নাম বচ্চন, কারো নাম কেঁদরা, এমনকি একজনের নাম
ইঞ্জিন। হ্যান্ডেলের বাবার নাম অবিশ্যি ছিল উকিল হেমব্রম। সেই নামটার কারনও কেউ
জানত না।
উকিল
এখন স্বর্গবাসী। যদি অবিশ্যি অত মদ গিলে লিভার পচিয়ে স্বর্গে যাওয়ার সুযোগ থাকে।
কিন্তু তার জায়গাজমি ভালই ছিল। হ্যান্ডেল একমাত্র ছেলে। তার ভবিষ্যতের কোনো ভাবনা
নেই।
কেউ
জানে না, ছেলেবেলা থেকে তার স্বপ্ন ছিল একটা দুর্দান্ত ফর্সা মেয়েকে বিয়ে করার,
ঠিক ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত যেমন। বৃষ্টির মধ্যে তার স্বপ্নটা এতদিনে বাসা বেঁধেছে। বিয়ের
স্বপ্ন না হোক, স্বপ্ন তো বটে।
দুস্তর
বাধা, সে জানে। সে জানে কোনোভাবে কথাটা ফাঁস হলে বাপিই তাকে কেটে ফেলবে। যদি বাপির
হাত থেকে বাঁচে, গ্রামছাড়া হতে হবে। জগন্নাথ প্রতিহার পার্টির বড়ো নেতা এখন।
হ্যান্ডেল জানে, তার সবকিছু চলে যাবে একটু বেচাল হলেই। তার প্রেমের সামনে নিকষ
অন্ধকার।
বৃষ্টির
একটা ব্রা সে হাতসাফাই করতে পেরেছিল। তাতে বৃষ্টির ঘাম আর গন্ধ লেগে ছিল ভরপুর। এখন
মিলিয়ে এসেছে। তবু ওটুকুই তার দিনের সম্বল, রাতের সর্বস্ব।
কিন্তু
আশার কয়েক চিলতে আলোও সে দেখেছে।
দেখেছে
যখন জিতে আনা মোরগকে সে পালক ছাড়িয়ে জলে ডুবিয়ে এক টানেই দু-ফাঁক করে দেয়, মুন্ডু
ছিঁড়ে নেয় রোগা কালো হাতের জোরেই, বৃষ্টি কেমন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। যখন নিজেদের
আহত মোরগের শুশ্রূষা করা হয়, পালক সন্তর্পনে সরিয়ে তার লাল লম্বা ক্ষতের মধ্যে
হলুদবাটা ভরে সাধারণ সূঁচ-সুতোয় সেলাই করা হয়, বৃষ্টি হ্যান্ডেলের রোগা কালো হাতের
দিকেই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে, বরের দিকে নয়। একবার তো
মজা করে বলেছিল, ‘যাক বাবা! আমাদের অনেক বড়ো ডাক্তারবাবু আছে। কারো কিছু হলে
চিন্তা নাই।’
বিরাট
টান একটা আছেই তার প্রতি, সেটা বোঝা যায়।
অন্যরকম
কিছুও কি নেই? চোখে চোখ পড়লে বৃষ্টি সঙ্গে সঙ্গে নজর ঘুরিয়ে নেয় না, চোখে রাখতে
দেয় কিছুক্ষণ। তার সামনে পোশাক এলোমেলো থাকলেও চলে আসে। অনেকখানি বুক হ্যান্ডেলের
দেখা হয়ে গেছে, কোমর দেখা হয়ে গেছে...
এই
তো পরশু, রাত দশটার পরে তারা লড়াই থেকে ফিরল একটা মোরগ জিতে। সেটাকে বাপিই ছাড়াচ্ছিল।
পাশে দাঁড়িয়েছিল হ্যান্ডেল, আর বৃষ্টি। বৃষ্টি টর্চের আলো দেখাচ্ছিল বরকে ডান
হাতে।
বাঁ
হাতটা আলগোছে লেগেছিল হ্যান্ডেলের প্যান্টের সামনে। হ্যান্ডেলের আখাম্বা লিঙ্গ তো
সঙ্গে সঙ্গেই যাচ্ছেতাই ব্যাপার শুরু করেছিল। কিন্তু বৃষ্টির হাত সরেনি। তারপরে পরীক্ষাছলে
হ্যান্ডেল নিজের হাত খুব হাল্কা করে ছুঁইয়েছিল বৃষ্টির পাছার খাঁজে। বৃষ্টি নড়েনি।
খেয়াল
করেনি?
তা
আবার হয়? মেয়েছেলেরা এসব ব্যাপারে সব খেয়াল করে।
অর্থাৎ,
আশা আছে।
আর,
আজই একটা সুযোগ আছে। আজ মোরগ লড়াইয়ে যাওয়ার দিন নয় হ্যান্ডেলের। আজ অন্য একটা দিন। আজ
তার সবকিছু বদলে যাবে। এই দিন জীবনে আর না-ও আসতে পারে।
সারাটা
দিন হ্যান্ডেলের সত্যিই অন্য দিন গেল। বাইরে-বাইরে আপনমনেই ঘুরে বেড়াল। বাড়ি ফিরেও
মা-বোনের সঙ্গে প্রায় কোনো কথাই বলল না। দুপুরে নুন-লংকা দিয়ে অল্প একটু পান্তা
খেল, গরম ভাতের দিকে ফিরেই তাকাল না। সোজা এসে শুয়ে পড়ল। নতুন কেনা মোবাইলে পানু
চালাল। বাংলা পানু ভরে দিয়েছিল স্থানীয় দোকানটা। অনেকগুলো আছে। হ্যান্ডেল প্রতিদিন
একটা দুপুরে আর একটা রাতে দেখে। বৃষ্টির ব্রা থাকে বুকের উপরে। তখন হ্যান্ডেল প্যান্ট
আর পৃথিবীর গান শুনতে পায়। নিজেকে তার দেবতা-দেবতা লাগে। তখন তার গায়ে কেউ হাত
রাখলে ছিটকে যাবে, একটা শুকনো পাতা পড়লে জ্বলে যাবে।
আজ
পানু দেখতে দেখতেই হ্যান্ডেলের মাথায় একটা পরিকল্পনা এল। লুঙ্গি খুলে সে প্যান্ট
পরল। কিন্তু জিপ টানল না। বিছানায় বসল। বৃষ্টির ব্রায়ের দিকে তাকিয়ে মনঃসংযোগ করতে
শুরু করল। হঠাৎ তার ছোট বাঁকা কিন্তু প্রচন্ড কালো লিঙ্গটি লাফিয়ে বেরোল খোলা
জিপের বাইরে বাতাসে। ঢোকাল। আবার লাফিয়ে বেরোল। বেশ কয়েকবার এটা করার পর সে নিজের
মনে হাসতে শুরু করল।
কেউ
বিশ্বাস করবে তার রোগা শরীরে এমন একখানা লীলা করার যন্তর আছে! কালো মুখের লাবণ্যে
ঝকঝকে দাঁতগুলো ধার ছড়াচ্ছিল। প্যান্ট খুলে দেওয়ালের পেরেকে ঝুলিয়ে আবার শুয়ে পড়ল।
বাপি
আজকের অমন লড়াইয়ে না গিয়ে থাকতে পারবে না। ওর বাপ-মাও থাকছে না...
লড়াইয়ে
যাওয়ার আগে বাপি আবার ফোন করে ডাকবে না তো?
হ্যান্ডেল
তার মোবাইল স্যুইচড অফ করে রেখে দিল।
আশ্চর্য,
হয়তো পান্তা খাওয়ার ফলেই, ঘুমিয়েও পড়ল।
শেষ
অবধি বাপি বৃষ্টিকে একলা রেখেই চলে গেল। সঙ্গে নিয়েছে দূর সম্পর্কের দাদা
সুকুমারকে। শ্বশুর-শাশুড়ি সকালেই চলে গেছেন।
বাড়ি
ফাঁকা। বাইরে শীতকালের সন্ধেবেলা। সামনেই
অমাবস্যা। ঘন অন্ধকারের মধ্যে তাদের মাটির পাঁচিল ঘেরা দোতলা বাড়িটা যেন কোনোরকমে সামলে
রেখেছে নিজেকে। বাপির দু-একটা ছেড়ে রাখা মোরগ আর কিছু ঘরোয়া মুরগি উঠোনে ঘুরে
বেড়াচ্ছে। তাদের চলাফেরার আওয়াজে একটু যেন ভরসা পাওয়া যাচ্ছে প্রাণে।
বাপি
বেরিয়ে যাওয়ার পরে বৃষ্টি অবেলাতেই গা ধুয়েছে। তারপরে তার বেশ শীত-শীত করছিল। এক
গ্লাস চা বানিয়ে খেয়েছে। কিছুক্ষণ টিভি দেখারও চেষ্টা করেছে। মন বসেনি। বাইরের
ক্রমেই ঘন হয়ে আসা অন্ধকারটা যেন গর্জন করছে, এখনই যেন লাফিয়ে ঢুকবে ঘরের মধ্যে,
তাকে তুলে নিয়ে বেরিয়ে যাবে কোথাও। দূরের বনের
মাথাটা আবছা বোঝা যাচ্ছে। ওই বনের মধ্যেই বুনো হাতির পাল। তারা লোকালয়ে আসে না।
কিন্তু এই বাড়িটা লোকালয়ের একেবারে প্রান্তে। অনেক দূর অবধি অন্য কোনো বাড়ি নেই।
হাতিরা এসে পড়তেই পারে।
সত্যিই
অসম্ভব একা লাগছে বৃষ্টির। সত্যিই ভীষণ
ভয় করছে। এর আগে কোনোদিন সে রাতে বাড়িতে একলা থাকেনি। ছেলেবেলা থেকেই বৃষ্টি ভূতকে
ভয় পায়, সাপকে ভয় পায়, এখন তো আবার যোগ হয়েছে বুনো হাতির ভয়।
বাপি
মোবাইল ফোনটা ফেলে গিয়েছিল। বৃষ্টি তার মাকে ফোন করবার চেষ্টা করল। বাপের বাড়িতে
বেশি কথা বললে এরা রাগ করে, ধমক দেয়, কিন্তু এখন কথা বলতে পারলে ভয়টা কাটত।
টাওয়ার
নেই। বাড়ির মধ্যে টাওয়ার পাওয়া যায় না। বাপি বাইরে বেরিয়ে অনেক কসরত করে ফোন
লাগায়।
গায়ে
একটা পাতলা চাদর জড়িয়ে উঠোনের সামনে একটা চেয়ারে বসল বৃষ্টি। ভয়, মোরগ-মুরগিগুলোর
একঘেয়ে চলাফেরা আর বাইরের অব্যক্ত সব আওয়াজের মধ্যে তার তন্দ্রা এসে গেল।
চমকে
জেগে উঠল কড়া নাড়ার আওয়াজে।
এখন
আবার কে এল? বাপি কি ফিরে এল?
সে
পাঁচিলের দরজার কাছে গিয়ে কাঁপা গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘কে?’
বাইরে
থেকে নীচু গলায় উত্তর এল, ‘আমি গো! হ্যান্ডেল।’
বৃষ্টি
দরজা খুলল। দরজা খুলতেই একটা তীব্র সুগন্ধ তার নাকে এল। হ্যান্ডেল সেন্ট লাগিয়েছে।
বেশ সাজগোজ করেছে। হয়তো বাইরে কোথাও গিয়েছিল, বাড়ি ফেরার পথে দেখা করতে এসেছে।
বৃষ্টি
হাই তুলে বলল, ‘ঘরে কেউ নাই।’
‘ক্যানে?’
‘সব
বেরিছে। তমার দাদা মোরগ লড়াইয়ে গেছে। তমাকে তো ফোন করে-করেও পেলনি। সুকুমারদার
সঙ্গে গেছে।’
‘অ!’
হতাশ হ্যান্ডেল কী বলবে যেন বুঝতে পারছে না।
বৃষ্টি
বলল, ‘এসো না ভিতরে। চা খেয়ে যাও।’
হ্যান্ডেল
এককথায় বলল, ‘চল।’
হ্যান্ডেল
ভিতরে এল। বৃষ্টি একটু আগে যে চেয়ারে বসেছিল, সেটাতেই বসল। চারদিকে তাকিয়ে একটু
অদ্ভুত হেসে বলল,‘ঘরের সব আলো জ্বেলে দিয়েছু যে! ভয় করছিল নাকি? কী ঠান্ডা পড়েছে,
বল বৌদিদি?’
বৃষ্টি
ঠোঁট উল্টে বলল, ‘কই ঠান্ডা ! আমার তো ত্যামন কিছু ঠান্ডা লাগছেনি! এমনিই চাদরটা
একটু জড়ি আছি।’
হ্যান্ডেলের
হাসি আরো চওড়া হল, ‘গরম হয়ে আছু। বাপিদা
ফিরবেক কখন?’
‘সে
আমি কী জানি? আমি কি মোরগ লড়াইয়ে গেছি কুনুদিন? উসব খবর তমরাই জানো। বোসো। চা
করি।’
রান্নাঘরে
চা করছিল বৃষ্টি। পিছন থেকে তাকে দেখতে পাচ্ছিল হ্যান্ডেল। আজ পিঠ দেখা যাচ্ছে না।
চাদর এখনও জড়িয়ে আছে।
হ্যান্ডেল
জিপ টেনে দুপুরের খেলাটা আরেকবার দেখানোর ডাক দিল তার তৈরি লিঙ্গকে। শুকনো গলায়
বলল, ‘তোর বরের খবর আমি কী রাখব বৌদিদি? তুই-ই তো রাখবি বটে!’
চা
বানানো হয়ে গেছে। গ্লাসে ঢালতে ঢালতে খিলখিলিয়েই হেসে উঠল বৃষ্টি, ‘আমি ছাড়া আমার
বরের খবর সবাই রাখবে।’
হ্যান্ডেল
ঢোঁক গিলে বলল, ‘ক্যানে?’
জবাব
না দিয়ে বৃষ্টি হাসতে হাসতেই এগিয়ে আসছে... হ্যান্ডেল এবার দমবন্ধ করে খেলাটার
জন্য তৈরি...
চায়ের
গ্লাস এগিয়ে এল...
বৃষ্টির
স্তম্ভিত দৃষ্টির সামনে হ্যান্ডেলের ছোট বাঁকা কিন্তু প্রচন্ড কালো লিঙ্গটি লাফিয়ে
বেরোল খোলা জিপের বাইরে বাতাসে...একটা অবাধ্য গিরগিটির মতো...কালো মুখের লাবণ্যে
ঝকঝকে দাঁতগুলো ধার ছড়াচ্ছে...
বৃষ্টি
কিছুই ভাবার সুযোগ পেল না। তার আগেই একটা একেবারে বিশ্রী অচেনা অনুভূতি তাকে এক
মুহূর্তও সময় না দিয়ে গ্রাস করে ফেলল। বৃষ্টি
নিজের অজান্তেই গ্লাসের পুরো চা-টা ঢেলে দিল হ্যান্ডেলের জিপখোলা কোলের উপরে...
সৌভাগ্যের
ব্যাপার হল, বৃষ্টির বানানো চা কখনই খুব গরম হয় না।
#
দুপুর
থেকেই শুরু হয়েছিল রক্তপাত। বাতাসে ছিটকে উঠছিল বিভিন্ন রঙের এলোমেলো পালক, আর লাল
ধুলো। হাঁড়িয়া, মহুয়া, তাড়ি আর দেশি মদের ভরপুর আয়োজন। এখানে সবাই পুরুষ। মেয়েদের
প্রবেশাধিকার নেই। অশ্লীল কথাগুলো বিড়ির ধোঁয়ার সঙ্গে উড়ে বেড়াচ্ছিল হাওয়ায়।
মাঝেমধ্যেই উল্লাসের ধ্বনি, আফশোসের শব্দ, তর্কবিতর্ক। এ একটা নেশার চেয়ে অনেক
বেশি কিছু। এখানে শুধু জয়-পরাজয় নেই, মাংসের লোভ নেই, তার চেয়ে অনেক আলাদা কিছু
আছে। হিংসার ধারণা এখানে ঠিক ততটাই ফালতু, যতটা শান্তির। এখানকার মাটিতে রক্ত পড়লে
সহসা চেনাই যায় না।
দু-দুটো
মোরগ নিয়ে আজকের লড়াইয়ে গিয়েছিল বাপি প্রতিহার। দুঃখের
কথা, যে মোরগটার উপরে তার এতদিনের ভরসা ছিল, শ্রম ছিল, সেটার প্রথম লড়াইয়েই ভরাডুবি
হল। সামনের মোরগটা যখন তার পায়ে বেঁধে দেওয়া
ছোট বাঁকা কিন্তু প্রচন্ড ছুরিকাটি নিয়ে লাফিয়ে উঠল, বাপির দামি মোরগ সামলাতেই
পারল না। সরাসরি গলা কাটা গেল, সটান মারা পড়ল।
হতাশ
বাপি তখনই বাড়ি ফিরে আসতে চেয়েছিল। সুকুমার সেটা হতে দেয়নি। দ্বিতীয় মোরগটার লড়াই
অদ্ভুতই হল। সে আগাগোড়াই বেকায়দায় ছিল। প্রতিপক্ষ মোরগটা তাকে ক্ষতবিক্ষত করছিল।
কিন্তু সে জায়গা ছাড়ছিল না। হঠাৎ তার জোশ এসে গেল। মারমুখি হয়ে তেড়ে যেতেই সামনের প্রতিপক্ষ
মোরগটা ঘাবড়ে পালিয়ে যায়। পালানো মানেই পরাজয়। পালানো মানেই শত্রুর ঘরে মাংস,
পালানো মানেই মৃত্যু। ওরা প্রায় অক্ষত মোরগটা পেয়ে গেল। আজকের লড়াইয়ে ওটুকুই লাভ।
বাড়ি
ফিরে জয়ী মোরগটার শুশ্রূষা আজ বাপিকে একাই করতে হবে। হ্যান্ডেল যেহেতু নেই।
লড়াইয়ের
মাঠে ওসব দিকে ফিরে না তাকালেও, ফেরার পথে দুজনে জমিয়ে হাঁড়িয়া খেল। আজ বাপ-মা
বাড়ি নেই। বাপি এই সুযোগে একটু বেশিই খেল। ফেরার রাস্তায় বাইক চালাল সুকুমার। বাপি
সুকুমারকেই মোরগটা দিতে চাইল। কিন্তু তার বাড়ির লোক রাত্তিরে মাংস খায় না।
অগত্যা
জয়ী ও পরাস্ত দুটো মোরগ এবং বাপি বাড়ি ফিরল। বাইক থামিয়েই অবাক হয়ে দেখল পাঁচিলের
দরজা খোলা, ভেতরে উঠোন এবং ঘরগুলোর সব আলো জ্বলে আছে।
আচ্ছন্ন
মাথাতেও বাপি একটু ঘাবড়ে গেল। মোরগদুটোকে উঠোনে ফেলে নিজেদের শোবার ঘরে ঢুকল সে।
এই
ঘরটাতেই একমাত্র অন্ধকার। আলো জ্বেলে দেখল বিছানায় শুয়ে আছে
বৃষ্টি।
একটা
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাপি বলল, ‘শুয়ে আছু কেন? রাঁধাবাড়া করিসনি?’
কোনো
উত্তর নেই।
কথা
না খুঁজে বাপি সরাসরিই বলল, ‘একটা মোরগ এসছে। উঠ।
মেরে রাঁধব।’
বোজা
গলায় উত্তর এল, ‘তুমি মারো। তুমি রাঁধো।’
‘ক্যানে?
কী হইছে তোর?’
বিছানায়
উঠে বসল বৃষ্টি। বাপি দেখল মেয়েটা প্রচুর কেঁদেছে। বালিশ ভিজিয়ে ফেলেছে। সারা মুখ
সিঁদুরে জলে মাখামাখি। চোখ আর ফর্সা নাকের ডগা টকটকে লাল। নাকের
জল মুছে বৃষ্টি বলল, ‘আমি আর থাকবনি তমাদের এখিনে। কালই
চলে যাব।’
‘কুথাকে
যাবি?’ বাপি হাসল। ‘এত রাগ তোর... বাপের ঘর থিকেও তো তোকে তাড়ি দিবেক! তখন কী
করবি?’
‘রাস্তায়
পড়ে থাকব। গাছতলায়।’ কঠিন গলায় উত্তর দিল বৃষ্টি।
এতক্ষণে
এত নেশার মধ্যেও রাগ হল বাপির। বাপি স্থির তেতো গলায় বলল, ‘আর, খাবি কী? বোলতা?’
দুটো
বছর লাগল মেয়েটার- জীবনের দু-দুটো বছর, মুহূর্তের পর মুহূর্ত- এই প্রশ্নটায়
পৌঁছতে। নিজেকে খুব খাঁটি লাগল বৃষ্টির, স্পষ্ট লাগল, অপরাজেয়, যখন ও উত্তর দিল :
‘গু।’
[কর্নেলকে নিবেদিত]
No comments:
Post a Comment