যতই আমরা বলি না কেন, শিল্পীর মৃত্যু নেই, কেননা তাঁরা
তাঁদের সৃষ্টির মধ্যে দিয়েই পাঠক-মানসে আংশিক অমরত্ব পেয়ে যান, তবুও, প্রিয়
কবি-লেখককে হারানোর বেদনা, কোথাও না কোথাও, একটি লুকোন চোরা-ফাটলের মত আমাদের
ক্লিষ্ট করে। উৎপলকুমার বসুর মৃত্যুসংবাদ শোনার পর থেকে এই ভাবনাটাই বারবার মাথায়
ঘুরছিল। কেননা, তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথে আমরা হারালাম বাংলা কবিতার এক অনন্য
স্থপতিকে। হারালাম এমন এক কবিকে, যাঁর হাতে জীবনানন্দ-পরবর্তী বাংলা কবিতার একটি
উল্লেখযোগ্য বাঁকবদল সূচিত হয়েছিল।
বাংলা কবিতায়, বহুদিন অবধি, উৎপলকুমার ছিলেন একটি প্রান্তিক
স্বর। তাঁর লেখালিখির সূত্রপাত যদিও কৃত্তিবাসের পাতায়, কিন্তু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
বা শক্তি চট্টোপাধ্যায়রা যখন ক্রমশ খ্যাতির চূড়ায় আরোহণ করছেন, উৎপল তখন দেশের
বাইরে, লণ্ডনে, লেখালিখি প্রায় বন্ধ বললেই চলে। প্রত্যাবর্তনের পরও, তাঁর লেখালিখি বহুদিন অবধি
সীমাবদ্ধ ছিল ছোট পত্রিকায়। ‘লোচনদাস কারিগর’, ‘খণ্ডবৈচিত্র্যের দিন’, ‘সলমা-জরির
কাজ’, ‘নাইটস্কুল’, ‘কহবতীর নাচ’ বা ‘টুসু আমার চিন্তামণি’ বেরিয়েছে পুস্তিকার
আকারে, কোন-না-কোন ছোট পত্রিকার উদ্যোগে। ২০০৬ সাল নাগাদ তাঁর আনন্দ
পুরস্কার-প্রাপ্তি তাঁকে প্রকৃত-অর্থে প্রচারের আলোয় নিয়ে আসে। কিন্তু তার আগে
থেকেই, উৎপলকুমার বসুর একটি নির্দিষ্ট পাঠকগোষ্ঠী, ছোট হলেও, ধীরে ধীরে গড়ে
উঠেছিল। আবার, তাঁর বিরুদ্ধে শোনা গিয়েছিল অনর্থক জটিলতার অভিযোগও। এহেন অভিযোগের
প্রথম ও প্রধান কারণ এই যে, আবহমান বাংলা কবিতা, যা মূলতঃ লিরিকাল—অর্থাৎ
অনুভূতিবেদ্য ও আবেগনির্ভর—তার সম্পূর্ণ বিপরীতমেরুতে দাঁড়িয়ে ছিলেন উৎপলকুমার।
তাঁর সমস্ত লেখালিখিতে, কবিতাযাত্রায়, তিনি একটি প্রতর্কের পরিসর তৈরি করতে
চেয়েছিলেন—সে-প্রতর্ক কখনো দার্শনিক, আবার কখনো-বা সমাজ-রাজনৈতিক। কিন্তু সবসময়েই
তা পাঠকের অংশগ্রহণ দাবি করে। অর্থাৎ, সোজা কথায়, উৎপলকুমারের কবিতার একটি স্পষ্ট
বুদ্ধিবাদী প্রবণতা রয়েছে। এদিক থেকে তাঁর তুলনা চলে অমিয় চক্রবর্তী বা
সুধীন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে। জীবনানন্দ, তাঁর ইতিহাস ও কালচেতনা সত্ত্বেও, শেষ অবধি
ব্যক্তিগত আবেগকে ছাপিয়ে নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণে ব্রতী হতে পারেননি।
জীবনানন্দ-পরবর্তী বাংলা কবিতায়, উৎপলকুমারের ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হয়ে ওঠার ঘটনা,
তাই একটি বাঁকবদলের ইঙ্গিত বহন করে বলেই মনে হয়।
এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই যে,উৎপলকুমারের মৃত্যুর পরেও, আমাদের
সঙ্গে রয়ে যাবে তাঁর কবিতাগুলি। অনেকদিন পরেও, কেউ-না-কেউ তার প্রেমিকার উদ্দেশ্যে
লিখবে, “মন মানে না বৃষ্টি হলো এত/ সমস্ত রাত ডুবো-নদীর পারে/ আমি তোমার
স্বপ্নে-পাওয়া আঙুল/ স্পর্শ করি জলের অধিকারে”। তবুও, আর কোনদিন নতুন কোনো কবিতার প্রত্যাশা
থাকবে না তাঁর কাছে, এ-কথা মেনে নেওয়া বড় কঠিন।
একটি ব্যক্তিগত উপলব্ধি
উৎপলকুমার বসুর কবিতায়, আমার অন্যান্য বন্ধুদের তুলনায়, আমি
হয়তো কিছুটাবিলম্বেই দীক্ষিত হই। ২০০৩-০৪ সন নাগাদ, তখন কলেজে পড়ি, হাতে এসেছিল
উৎপলকুমারের ‘কবিতাসংগ্রহ’। যদিও তারও আগে, শঙ্খ ঘোষের কোনো একটি প্রবন্ধে প্রথম
উৎপলকুমারের উল্লেখ পাই, ও আগ্রহী হয়ে উঠি তাঁর কবিতা-পাঠে। কিন্তু এ-কথা অনুমান
করার সাধ্য আমার ছিল না যে, এই কবির কবিতা, প্রথম পাঠেই,এক বিপুল ও অনির্দেশ্য
রহস্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেবে আমাকে,এবং একে-একে ভেঙে দেবে কবিতা-সংক্রান্ত
আমার সমস্ত পূর্বানুমিতিগুলি। ও এর ফলে, অচিরেই আমি এক দুরপনেয় বৌদ্ধিক বিপন্নতায় আক্রান্ত হব। যদি যথেষ্ট
সময়ের ব্যবধানে, ও একটি নির্দিষ্ট ধারাবাহিকতা মেনে, আলাদা-আলাদা করে পড়তাম
‘চৈত্রে রচিত কবিতা’ থেকে ‘পুরী সিরিজ’/‘আবার পুরী সিরিজ’ হয়ে‘লোচনদাস কারিগর’ বা ‘সলমা-জরির
কাজ’, তাহলে হয়তো আমার পক্ষে আরেকটু সহজ হত এই ব্যতিক্রমী কবিকে বোঝার ও আত্মস্থ
করার প্রক্রিয়াটি। কিন্তু, ‘কবিতা সংগ্রহে’র মধ্যে দিয়ে, উৎপলকুমার বসু আমার
চৈতন্যে ঝাঁপিয়ে পড়লেন তাঁর সমস্ত পূর্বাপর নিয়ে, তাঁর সমস্ত ভাঙা-গড়া, জটিলতা,
অনন্যতা ও মুদ্রাদোষ সমেত।
আসলে, উৎপলকুমার বসুর কবিতায় একটি ক্রমিক বিবর্তনের ইতিহাস
রয়েছে—শুধুমাত্র ভাষা বা ভঙ্গিমার নয়, সামগ্রিক বিশ্বদর্শনেরও। এতদিন পর, এখন
বুঝতে পারি, উৎপলকুমারের কবিতার এই দার্শনিক বিবর্তনটিকে অনুধাবন না-করলে তাঁর
কবিতাকে পুরোপুরি বোঝা (সত্যিই যদি কবিতাকে বোঝা যায়!) বোধহয় কখনই সম্ভব হবে না। তাঁর
সম্পূর্ণ কাব্যসম্ভারের মধ্যে তো বটেই, এমনকী, ‘চৈত্রে রচিত কবিতা’ থেকে
‘সলমা-জরির কাজ’ অবধি মোট সাতটি (‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ বাদ দিয়ে) গ্রন্থের মধ্যেও এই
বিবর্তনের একটি আলগা রূপরেখা আবিষ্কার করা সম্ভব, এমনটাই ইদানীং আমার অনুমান।
সূর্য, সমুদ্র, মানুষ
আজ থেকে কয়েক হাজার বছর আগে, যে-বিস্ময় থেকে মধ্য-এশিয়ার
পশুপালক, যাযাবর এক মানবগোষ্ঠী মুখে মুখে রচনা করেছিল রহস্যময় ঋকসমূহ, যে-বিস্ময়
থেকে দক্ষিণ আমেরিকার মাইয়ান ইন্ডিয়ানরা রচনা করেছিল ‘পোপোল ভু’, অর্থাৎ যে-বিস্ময়
থেকে উৎসারিত মানুষের যাবতীয় পুরাণকল্পনা ও উপকথা, যদি বলি সেই একই বিস্ময় থেকে
লিখিত হয়েছিল উৎপলকুমারের ‘চৈত্রে রচিত কবিতা’র কবিতাগুলি, তাহলে হয়তো খুব একটা
অত্যুক্তি হবে না। কেননা, এই বিপুল পৃথিবী ও নিসর্গের সামনে, তথা সৌরমন্ডলের নিচে
দাঁড়িয়ে মানুষের বিস্ময় ও বিপন্নতা আজকের নয়, বরং তা চিরকালীন। হয়তো প্রকাশের ভঙ্গিমা
বদলায়, ভাষা বদলায়, কিন্তু অন্তর্নিহিত প্রশ্নটি মূলগতভাবে একই থাকে।‘চৈত্রে রচিত
কবিতা’র শুরুতেই, তিন নম্বর কবিতায় এই ভাবকল্পটি ধরা পড়ে যায়—
‘বহুদিন ছুঁয়ে
যায় বর্তুল, বিস্মিত পৃথিবী
লাটিম
সূর্যের তাপে নানা দেশ—বিপুল শূন্যতা—
সে যেন
বিচিত্র আলো দিয়েছিল আমার ঘরের
গবাক্ষবিহীন কোনো অন্ধকারে—একদিন—শুধু একদিন’
সূর্যের মোটিফ, এই গ্রন্থের অধিকাংশ কবিতায় ঘুরেফিরে এসেছে।
এসেছে ঋতু, চাঁদ তথা নক্ষত্রমন্ডলের প্রতীক। বলা যেতে পারে, এই গ্রন্থের প্রতিটি
কবিতাই যেন প্রাকৃতিক ও মহাজাগতিক রহস্যের উদ্দেশ্যে লিখিত একেকটি স্তোত্র। যেভাবে সিন্ধুসভ্যতার শীলমোহরে খোদাই করা হয়
মাতৃকামূর্তি, বা বৈদিক স্তোত্রে বসুধাকে ‘মাতা’ হিসাবে বর্ণনা করা হয়, ঠিক সেই একই
প্রণোদনায় উৎপলকুমার লেখেন—
“আমি তার
নির্মম পায়ের তলে মাথা রেখে বলি,
‘তুমি
আমাদের আদিম বসুধা, মাতা
নক্ষত্রে তোমার মুক্তি’”
এক বিপুল ও ব্যাপ্ত শূন্যতার মাঝখানে মানুষের সমস্ত
মুগ্ধতা, প্রশ্ন, অসহায়তা ও তজ্জনিত বিস্ময় ক্রমাগত ঘনিয়ে উঠতে থাকে চৈত্রে রচিত
কবিতাগুলির ভেতর। আর সেখানেই, আদিম
পুরাণপ্রতিমাগুলির সঙ্গে এই কবিতার এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-সম্বন্ধ স্থাপিত হয়।
অথচ উৎপল জানেন, আদিম মানুষের দৃষ্টির মধ্যে যে-সারল্য ছিল,
আজ, আমাদের পক্ষে আর তার অনুকরণ সম্ভব নয়। কেননা, তার ওপর জমা হয়েছে সহস্র বছরের
অর্জিত জ্ঞান, ভাষা ও শব্দের জটিলতা। একদিকে তিনি একে অস্বীকার করতে চান—“তারা
কেউ ধূর্ত নয়—দয়াশীল, বিনীত ভাষায়/বলে, ‘তুমি ভুলে যাও সমস্ত জ্ঞানের ভার—সমস্ত
অক্ষর’”, আবার অন্যদিকে সেই অস্বীকারের অন্তর্নিহিত অসম্ভাব্যতাও তাঁর অজানা
নয়—“চেতনা তোমার/মহাবনস্পতিতলে এক ম্লান বিপুল গ্রন্থের/হলুদ অধীর পাতা”,
কিংবা “আমার চেতনা শুধু শব্দের করস্পর্শে ভেঙে যায়”। এই উভয়সঙ্কটের দ্বিধাবিন্দুতে দাঁড়িয়ে থাকে
চৈত্রে রচিত কবিতাগুলি। আর, বইয়ের শেষ কবিতায়, মহান সঙ্গীতকার যোহান সেবাস্টিয়ান
বাখের উদ্দেশ্যে রচিত কবিতায়, উৎপলকুমারের জবানিতে এই নিরুপায় অভিলাষটিও লিপিবদ্ধ
হয়—
“একদিন বড়ো
মূর্খ হবো। বসন্তে ব্যাপক কোনো লতার আড়াল থেকে
গোপন পল্লবজাল সরিয়ে নির্ভয়ে একদিন ডাক দেব ‘কুহু’”
‘চৈত্রে রচিত কবিতা’র প্রধান মোটিফ যদি সূর্য বা
নক্ষত্রসমূহ, ‘পুরী সিরিজে’র কবিতায় তার জায়গা নেয় সমুদ্র। মহাকাশ থেকে মরপৃথিবীতে
অবতরণের এই ঘটনাটি নিছক আলঙ্কারিক নয়, বরং তার ভেতর উৎপলকুমার বসুর কবিতার প্রথম ও
প্রধান বাঁকবদলের ইঙ্গিতটি প্রচ্ছন্ন রয়ে গেছে। সমুদ্র একদিকে যেমন প্রাণের
ধাত্রী, অন্যদিকে তেমনই বাণিজ্যের নির্ভর। অতএব, অস্পষ্ট
দিগন্তরেখার দিক থেকে উৎপলকুমারের দৃষ্টি, এক্ষণে, ন্যস্ত হল জীবনের ওপর—জীবন,
অর্থাৎ মানুষ, অর্থাৎ সমাজ ও সমকাল। এই সমাজ হয়তো-বা পণ্যভারাক্রান্ত, কোলাহলমুখর,ও
নিছকই বস্তুতান্ত্রিক—“তোমার বিনষ্ট মুখে রুধিরের বিসম্বাদী ডৌল/টলায় নাবিক,
পণ্য, কফি, নুন, কস্তুরী, গন্ধক/নাকছাবিটির হীরা—এত বস্তুগত সবই!”—কিন্তু,
তবুও, “মানুষকে ভালোবেসে, মানুষকে ঘৃণা করে”ই লিখিত হল ‘পুরী সিরিজ’।
নাক্ষত্রিক মহাজগত পুরোপুরি উধাও হয়ে গেল এমন নয়, তা রইল পটভূমি হিসেবে। কিন্তু, সেই
পটভূমির সামনে, প্রধান হয়ে দেখা দিল মানুষের ধারাবাহিক অভিযাত্রার কাহিনী। “উর্ধ্ববাহু,
পরাঙ্মুখ” সূর্যের বিপ্রতীপে “ধান, গোলাঘর, বীজের উত্থান” কিংবা “এঞ্জিন,
স্তব্ধ রেল, সাঁকো, বাড়ি, কলোনি, বাজার”-এর কাহিনী।
ভাবগতভাবে, ‘পুরী সিরিজ’ এবং ‘আবার পুরী সিরিজ’ সমগোত্রীয়। ‘চৈত্রে
রচিত কবিতা’-কে যদি পুরাণের সঙ্গে তুলনা করি, তাহলে এই দুই গ্রন্থের তুলনা চলে
লৌকিক গাথার সঙ্গে। লৌকিক গাথাগুলি যেমন পুরাণ থেকে উপাদান সংগ্রহ করে, কিন্তু
বদলে উপহার দেয় একটি স্বতন্ত্র, সহজ বীক্ষা, তেমনইএই দুটি কাব্যগ্রন্থ, ‘চৈত্রে
রচিত কবিতা’র সঙ্গে এক নিরন্তর বার্তালাপে মগ্ন হয়ে থাকে। ‘চৈত্রে রচিত কবিতা’র ‘কেবল পাতার শব্দে’
কবিতাটিকে ‘আবার পুরী সিরিজে’র বিভাব কবিতা হিসাবে ব্যবহার করে, এবং সেই কবিতার
প্রথম স্তবকটির সচেতন পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে (বিশেষত, ‘আজ’ বনাম ‘কাল’, ‘গীর্জার
শিখর’ বনাম ‘চাষের গান’, এবং ‘মাতৃকা মেরী’ বনাম ‘মায়ের মতন’), উৎপলকুমার এই
সংলাপটিকেই মান্যতা দেন। আবার, ‘পুরী সিরিজে’র অন্যতম সেরা কবিতা ‘ফেরীঘাট’,তার ভাবগত
বৈশিষ্ট্যেই, ‘চৈত্রে রচিত কবিতা’র সঙ্গে এক প্রত্যক্ষ সেতুবন্ধ রচনা করে।
এই যে টানাপোড়েনের সম্পর্ক, মহাজাগতিক বিস্ময়ের সঙ্গে
জাগতিক ঈপ্সার, তা ক্রিয়াশীল রয়ে যাবে উৎপলকুমারের পরবর্তী সমস্ত গ্রন্থে—‘লোচনদাস
কারিগর’, ‘খণ্ডবৈচিত্রের দিন’, ‘সলমা-জরির কাজ’ হয়ে ‘পিয়া মন ভাবে’ পর্যন্ত।
ব্যক্তিগত লিখনভঙ্গিমা
‘চৈত্রে রচিত কবিতা’র লেখাগুলি,
দু-একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে, সবই অক্ষরবৃত্তে লেখা। জীবনানন্দ ও জীবনানন্দের
সবচেয়ে উজ্জ্বল অনুসারী বিনয় মজুমদারের সঙ্গে এখানেই উৎপলকুমারের মিল। সে-লেখায়, অক্ষরবৃত্তের
গাম্ভীর্য পুনরায় অনুরণিত হয় তৎসম শব্দের প্রাচুর্যে। কিন্তু, ‘পুরী সিরিজ’ থেকেই
উৎপলকুমারের লেখার ভাষা ও গড়ন বদলাতে থাকে। এবং সে-বদল রীতিমত বৈপ্লবিক। ছন্দ
অক্ষরবৃত্ত হোক, বা মাত্রাবৃত্ত, তাকে পংক্তিবিভাজন ছাড়া, যতিচিহ্ন-ছাড়া বিন্যস্ত
করার সাহস উৎপলকুমারের আগে কেউ দেখিয়েছেন বলে মনে হয় না (“হস্তচালিত প্রাণ তাঁত
আধোজাগ্রত মেশিনলুম আমাদের হুররে” থেকে “সার্বভৌম বেশ্যাদের প্রকৃতির
জীবজগতের দারুপুতুলের ছবিগুলি মনে পড়ে”)। কোনো এক সাক্ষাৎকারে উৎপলকুমার বলেছিলেন, তাঁর এই যতিচিহ্ন-বর্জন আসলে
বিদ্যাসাগর-পূর্ববর্তী বাংলা-ভাষার কাছাকাছি ফিরে যাবার প্রয়াস। অর্থাৎ,
বাংলা-ভাষার ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকারকে অস্বীকারের প্রবণতা। এর ফলে, একদিকে পাঠকের
স্বাধীনতা বাড়ে শব্দগুলিকে যদ্দৃচ্ছা সাজিয়ে নেওয়ার, অন্যদিকে একটি কবিতা থেকে
তৈরি হয় একাধিক কবিতার বীজ। তাছাড়া, তাঁর কবিতার ভাষা,এই সময় থেকেই, ক্রমশ সরে আসে
মুখের ভাষার কাছাকাছি।‘পুরী সিরিজে’র শেষ কবিতা’য় এর উদ্ভাস বেশ স্পষ্টভাবেই লক্ষ
করা যায়,কিন্তু ‘লোচনদাস কারিগরে’ পৌঁছে দেখি, মুখের ভাষাই ক্রমশ কবিতা হয়ে উঠছে। দৈনন্দিন সংলাপ, চায়ের দোকানের আড্ডা—এসবও ক্রমশ কবিতা হয়ে উঠতে থাকে। ‘সুখের
কথা আর বোলো না’ কবিতার সেই বিস্ময়কর “কাপি কাপি নো মিল্ক” এরই এক চূড়ান্ত
উদাহরণ। মৌখিক, লোকায়ত ভাষার ব্যাপক ব্যবহার, এরপর, আজীবন জারি থাকবে উৎপলকুমারের
কবিতায়, ‘সলমা-জরির কাজ’ হয়ে ‘নাইটস্কুল’ বা ‘অন্নদাতা যোসেফ’-এও। তাঁর এই
পর্যায়ের লেখা শব্দের ভারে ভারাক্রান্ত নয়, গঠনগত পরীক্ষা-নিরীক্ষাও তাতে আর ততটা
প্রকট নয়। বরং, যেন কবির সামনে বসে একটুকরো সরস গল্পগুজবের ভাগ
নিচ্ছে পাঠক—এমনই মায়াবী, ভণিতাহীন এইসব কবিতা। ‘নাইটস্কুলে’র ভূমিকা কবিতাটির কথা, এই প্রসঙ্গে, কীভাবেই বা ভুলে যাওয়া
সম্ভব?
‘পুরী সিরিজ’-এর কবিতাগুলির আরেকটি
বৈশিষ্ট্য, তাদের আপাত-জটিল প্রতীক-বিন্যাস। একদা, বাংলা কবিতায় ‘উটের গ্রীবার মত
কোন এক নিস্তব্ধতা’ সাড়া ফেলে দিলেও, উৎপলকুমারের ব্যবহৃত প্রতীকের বৈচিত্র্য
আমাদের আজও চমৎকৃত করে। গাছে গাছে কোকিল যে “কোকেইন, কোকেইন” বলেও ডেকে
উঠতে পারে, এ আমরা আগে ভাবিনি, দেখিনি “সকালের দমকল ঘুরছে”-র মত বিস্ময়কর
রূপক। ‘প্রকৃতির ছবি (১৯৬৩)’ তো, সর্বার্থেই, প্রতিটি শব্দে অভিনবত্ব বহন করে আনে,
আজও। আবার একই সঙ্গে, না-বলে-কয়ে উৎপলকুমার তাঁর লেখায় ঢুকিয়ে দেন অন্য কোনো
কবিতার লাইন, বা রেফারেন্স। “বসন্তে এনেছি আমি হাবা যুবকের হাসি”-র সঙ্গে র্যাঁবোর
‘And Spring brought me the
frightening laugh of the idiot’-এর মিল আকস্মিক বা আপতিক নয়, নয়
কুম্ভীলকবৃত্তিও। বরং, এভাবেই গোপন সূত্রগুলি ছড়িয়ে রেখে যান উৎপলকুমার, সন্ধানী
পাঠকের মনোযোগের অপেক্ষায়।
“দ্বিবিধ অর্থময়
রায়গুণাকর” থেকে “লবটুলিয়া
ঘুরে এলেন কলকাতার শেরিফ” বা “আমার স্বপ্নের মধ্যে চলে যায় পদ্মাবোট”-এর
ভেতরেও পাঠকের সঙ্গে এমন মজাদার লুকোচুরি খেলারই আয়োজন সাজানো থাকতে দেখি। সচেতনভাবেএরকম
ইন্টার-টেক্সচুয়ালিটির ব্যবহার বাংলা কবিতায় সম্ভবতঃ উৎপলকুমারেরই অবদান। অবশ্য,
‘লোচনদাস কারিগর’-পরবর্তী উৎপলকুমার ফের সযত্নে সরিয়ে রাখবেন প্রতীকের ভার। বা,
প্রতীকগুলি আহৃত হবে আমাদের চারপাশের বাস্তবতা থেকেই। সাধারণকেই তখন অসাধারণ করে
তুলবেন উৎপলকুমার। ভাষা বা গড়নের দিক থেকে সেটাই উৎপলকুমার বসুর কবিতার তৃতীয়
বাঁক।
রগুড়ে চাপা ভালোবাসাবাসি
‘চৈত্রে রচিত কবিতা’য় প্রধান হয়ে
দেখা দিয়েছিল নশ্বর বিপন্নতা। তার ভাষায়, ভঙ্গিমায় তাই তীব্র বিষাদ ও অসহায়তার সুর
ফুটে ওঠে বারবার। যে-শিকল তাঁকে বেঁধে রেখেছে, তাকেই ছিন্ন করতে চাইছেন উৎপলকুমার
বসু, আর সেই লড়াইয়ের চাপে ফেটে পড়ছে শব্দগুলি, বাক্যের ভেতর। ‘পুরী সিরিজে’র
লেখাতেও এই লড়াই জারি রয়েছে, তবে তা আরেকটু নির্মোহ, নিস্পৃহ। সেইসঙ্গে, যুক্ত
হয়েছে শ্লেষ ও বিদ্রূপ। ‘আবার পুরী সিরিজে’র দু-একটি কবিতায় এর থেকে বেরিয়ে আসার
চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। এবং, উইট বা হিউমার তাঁর হাতে ক্রমশ এক বিপজ্জনক হাতিয়ার হয়ে
ওঠে।
উপযুক্ত পরিভাষার অভাবে, উইট বা
হিউমারকে বাংলায় রগড় বলা যেতে পারে হয়তো-বা। ‘সলমা-জরির কাজে’র ৫ নং কবিতায় (“মৌলিক
স্বাস্থ্যচর্চা করে যারা নাম কিনেছে”) বা ১০ নং কবিতায় (“সন্ধ্যেবেলা সবাই
যখন সিঙাড়া খায়, জিলিপি খায়, জলকচুরি খায়”) এই বৈঠকী রগড়ের পরিসরটিই ফুটে ওঠে
বারবার। এর সাথে বিশুদ্ধ শ্লেষ বা ব্যঙ্গের পার্থক্য রয়েছে। কেননা, এই রগড় কোনো
নির্মোহ, নৈর্ব্যক্তিক সমালোচনা নয়, বরং লেখক নিজেই এখানে মজার অংশীদার। আর, তার
চেয়েও বড় কথা, এই রগড়ের মূল সুরটি মানবিকতার—পরিপার্শ্বের প্রতি, জীবনের প্রতি এক
অকুন্ঠ মায়া থেকে উৎসারিত।“বন্ধু, তোমার হাতের উপর হাত রাখলেই আমি
টের পাই তোমার বাজারে অনেক দেনা, ছেলেটা উচ্ছন্নে গেছে,”—এর চেয়ে ঘনিষ্ঠ, মায়াবী উচ্চারণ আর
কীই বা হতে পারে? ‘পুরী সিরিজে’—যখন উৎপলকুমার প্রথম তাকিয়ে দেখছেন মানুষের দিকে,
পরিপার্শ্বের দিকে—একধরণের অসহিষ্ণুতা ছিল, ছিল ঝাঁঝ, ও আক্রমণাত্মক প্রবণতা। ধীরে
ধীরে, তাকেই প্রশমিত করলেন উৎপল, আরো স্থিতধী ও শান্ত হলেন। ফলহেতু, তাঁর কবিতার
ভাষাতেও সেই মমত্ব ও স্নেহময় কারুণ্যের দাগ লেগে রইল, বরাবরের জন্য।
এই নশ্বরতা, মায়া ও মানবিকতার
সুরটিই উৎপলকুমার বসুর কবিতার মুখ্য পরিচয় হয়ে রয়ে যাবে। রয়ে যাবে পুরাণ থেকে
লোকপ্রতিমায়, প্রাতিস্বিক থেকে নৈর্ব্যক্তিক উচ্চারণে, দৈনন্দিন বাস্তবের মাটি
থেকে পরাজাগতিক রহস্যে্র ভেতর তাঁর অনায়াস চলাচল। তাঁর কবিতা আমাদের ভাবাবে, এবং
ভাবাতেই থাকবে। মনে পড়ে যাবে, একদা তিনিই লিখেছিলেন—
“যখন সময় হবে, বোসো এই কাব্যের পাশে।
একে ভাঙ্গা টেবিলের মত তুমি কাছে টেনে নাও। রাখো গরম পেয়ালা
এরই অক্ষরের ‘পরে। জলের গেলাস রাখো। শোনো এও কাশে।
থুথু ফ্যালে। তোলে হাই। ঘুম এলে চোখ বোজে। যেন কালা
শোনে না অপ্রিয় সত্য।”
No comments:
Post a Comment