।। বাক্‌ ১২০।। মাসুদ খান ।।





আহুতি

তীক্ষ্ণফলা বেঁধনাস্ত্রে গেঁথে তুলে আনো সেই তুফানাশ্ব,  
উত্তেজিত টগবগে রূপ আর চূড়ান্ত গতির কাঠামোয়
গড়া যার সুঠাম শরীর,
আচমকা-আগুন-ধরে-যাওয়া যার উড়ালকেশর।  
কে না জানে-- দ্রুততম ঘোড়ার রক্তেই 
সম্পন্ন, সাধিত হয় যজ্ঞের আহুতি।

যিনি রাজা, তিনিই তো হোতা, অগ্নিহোতা,
এবং উদ্গাতা, এ-যজ্ঞের।  
রাজার অবর্তমানে প্রক্সি দেবে রাজদণ্ড
কিন্তু লগ্ন যায়-যায়, নৃপতি কোথায়?    
দেশে দেশে রাজদণ্ড আজও রতিবাহিত ব্যাধির মতো চণ্ড
স্নিগ্ধ বাতাসের দেশে, কূটবেশে, গুপ্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষারূপে
সুপ্ত থাকে ঘূর্ণ্যমান হিংস্র হ্যারিকেন-- মত্ত ও মাংসাশী।

জ্যোৎস্নায় ভিজতে থাকে তুষারিত ধু-ধু মাঠ
বরফেরা যেন তার শাদা-শাদা হিমায়িত উত্তাপ, সমিধ...


আনপ্লাগড অ্যান্ড আনলিশড, প্রমাদসংগীত

আধা-বাস্তব আধা-ফ্যান্টাসির যুগ পেরিয়ে সম্ভবত আমরা অজান্তেই প্রবেশ করেছি এক উচ্চতর ফ্যান্টাসির যুগে। এখন, এই তুঙ্গ পরিণামপর্বে, অজ্ঞাত আরশ থেকে প্রত্যাদেশ পেয়ে-- হ্যাভ আর হ্যাভ-নটস-- দুই ধ্রুপদী বৈরীপক্ষ পরস্পর হাতে-হাত কাঁধে-কাঁধ রক্তহোলি জঙ্গে নেমেছে অজানা ফ্যান্টমের বিরুদ্ধে, উদ্দেশ্যবিধেয়রিক্ত, নিশানাহীন নিশানা তাক করে।

বলপূর্বক-গুমের পিছে পিছে স্বেচ্ছা-গুম। উর্ধ্বকমার বন্দিদশা থেকে ছাড়া পেয়ে বন্দুকযুদ্ধ স্বয়ং ছুটছে দিগবিদিক। অতএব, এখন,কমাযুক্ত বন্দুকযুদ্ধের পিছে পিছে, এবং পাশাপাশি, কমামুক্ত সাচ্চা বন্দুকযুদ্ধ। ধরে-আনা নিরীহ বিড়াল, নির্যাতনে উদ্ভ্রান্ত,অবলীলায় কবুল করছে আমিই বাঘ আর সঙ্গে-সঙ্গে সেই বানোয়াট বাঘের কাহিনির পিছে পিছে সত্যিকার শ্বাপদসংগীত। 

কখনো কখনো এমন সময় আসে যখন যে-কোনো মামুলি কথা, যে-কোনো নির্দোষ জিজ্ঞাসাকেও মনে হবে জ্যান্ত সর্পরূপক। নকশিকাঁথার পাশে পড়ে-থাকা নিরীহ সুতাকে ভ্রম হবে সুতানলি সাপ। ছেলের হাতে-ধরা মোয়াকেও মনে হবে ‘ওরে বাপরে বাপ’!


গূঢ়লেখ

বেশ স্পষ্ট, প্রতিটি লক্ষণ।
আধাভেদ্য ঝিল্লির ভেতর দিয়ে ধীরগতি লোনা তরলের পারাপার,
তিক্ততায় ভরে যায় ঝিল্লিসীমা এপার-ওপার।

ধুম-উন্নয়ন।
অগ্রগতি-অঙ্কিত সড়কপথে যেতে হবে দূর থেকে বহুদূর পার
পথের দু-ধারে তার অন্তরাত্মা-ধাঁধিয়ে-দেওয়া বিপণিবাহার--  
বাঁয়ে বডি শপ, স্বর্ণবিতান, স্পা, পণ্যাগার, বিলাস-সদন
ডানে মনোহারি, দেহসুষমার দোকান-- তরঙ্গ-ও-বাঁক-উন্নয়ন...

স্তব্ধ হয়ে এলে বহুব্যঞ্জন, এবং বহুস্বর,
রাজ্য হয়ে ওঠে বৃন্দযৌনতার লীলাপরিসর
সে-রতি বহুপথিক, সে-গতি বহুধাগামী--  
অবাধ, আন্তঃশ্রেণিক, সম- ও বিষমকামী।   

বাক্যে-বাক্যে প্রতীকের এতটা দুর্ব্যবহার! ফলাফল--    
রুষ্ট হয়ে চলে যাচ্ছে শ্রাবকের দল।   
শ্রাবকেরা ফিরবে না আর-- সহজেই অনুমেয়
প্রতীকের অতিরেকে অতিষ্ঠ স্বয়ং প্রতীকেয়। 

বক্তব্য অনেক হলো। হলো বহু ঝালাপালা কথার আরতি
এবার ভোক্তার দাবি-- এ-কথারতির চাই স্পষ্ট পূর্ণযতি।
বক্তব্য আর না, ওরে বাচস্পতি, ওহে বাগীশ্বরী 
দিশাহারা ভোক্তা চায় এবার ভোক্তব্য সরাসরি।


কারুশিল্প

তোমার সহিংসতাটুকু আমিই তোমার হয়ে
সেরে আসি বাইরে গিয়ে। তবেই-না তুমি
সম্পূর্ণ অহিংসরূপে স্বর্গসুখে দিবানিদ্রা যাও।

সন্ধ্যাবেলা জেগে উঠে বলো-- বাহ্! করেছ কী কাণ্ড!
বাইরে কী অপরূপ রক্তবিকিরণ!
স্প্রাং রিদমের তালে-তালে জম্বি ছন্দে চলছে যজ্ঞ মনুমেধ--  
ওই যে থ্যাঁতলানো দেহ-- প্রতীকপ্রতিম ছিটকে-পড়া ঘিলু-- রূপকসমান
পোড়ানো হাত-পা মুখ-মাথা-- উপমেয়হারা উপমান
কাটা মুণ্ডু, ফাটা জিভ, বিমূর্ত চিত্রের মতো নাড়িভুঁড়ি, অনুপ্রাস,
থকথকে কূটাভাস, চকচকে চিৎকার, সত্রশিখা, উগ্র আগ্নেয় তুফান...
থেকে-থেকে যজ্ঞপটে জেগে ওঠে ভৌতিক জবান।
যোজনগন্ধার গন্ধকাহিনির মতো চমৎকার
রক্তের সুবাস ভেসে আসছে জানালায়।

সেইসঙ্গে এও বলো--
জীবাণুনাশক দিয়ে মুছে ফেলো সব আর্ট, তাড়াতাড়ি।
বিমূর্ত চিত্রের রূপ-- মূর্ত তো থাকে না বেশিক্ষণ।
পচে। গলতে থাকে। চণ্ড গন্ধ হয়। জীবাণু ছড়ায়...


সাব-জিরো সাইলেন্স

চোখ-বাঁধা জিম্মি-হওয়া মানুষ জানে না
ঠিক কোন মুহূর্তে গুলি এসে লাগবে ঠিক কোথায় কোথায়।
অচেনা রোমাঞ্চেরোমহর্ষে, ত্রাসে, সর্বোচ্চ সংরাগে
শরীরের প্রতি ইঞ্চি তাই প্রতিস্পর্ধীটানটান।
যেমন দেহের সবচেয়ে সংরক্ত জায়গা
পোশাকের ফেলে-রাখা ফাঁকা স্থান    

একদিকে তোমাতে সঞ্চার করা হবে
অনন্ত বাকতৃষ্ণাচিৎকারের উদগ্র তাড়না, উদ্গার
অন্যদিকে নিষেধ বাকস্ফুরণ। নিষেধ চিৎকার।
কোন দিকে যাবে?   

কোন দিক থেকে তেড়ে আসবে কোন ধারালো ছোবল,
কোন কোপকোন কার্তুজ, লেলিহ ফিসফাস--  
এই গা-ছমছম ভূতবান্ধব জ্যোৎস্নায়
বুঝতেও পারবে না আরওরে নিরুপায়।

এই এখনই শুনবে বহু ঘোলাটে ভয়ের ঘোলতরঙ্গবাদন
আবার এখনই উচ্চনাদী নীরবতা। 

কতশত সশব্দ উচ্চারঘুরে-দাঁড়ানো চিৎকার,
অন্তরাত্মা-কাঁপিয়ে-তোলা কান্নাআর্তি, আহাজারি,
বহুমাত্র বিচিত্র আওয়াজ--
স্রেফ দ্বিমাত্রিক কালো টোটেম-অক্ষর হয়ে  
একদম খামোশ মেরে থাকে তারা নিঃসহায়
কখনো তা ভাবদোষেকখনো-বা রাজরোষে
স্তরে-স্তরে-রাখা কল্পপুথির ঘোর-গুমসুম নিঝুম পাতায়।  

অতিরিক্ত অবদমনের অবশেষ
দোষযুক্ত স্বপ্নে ভরে যায় সারা দেশ।
স্বপ্নের ভেতর থেকে ঘটে যায় তার
লাভাভর্তি পিচকারির ঘন পিচিৎকার।


No comments:

Post a Comment