।। বাক্‌ ১২০ ।। গিরীশ গৈরিক ।।







ডোম সিরিজ 

সাদা অথবা বাতাবী অন্ধকার উবু হয়ে ঘুমিয়ে আছে- লাশকাটা ঘরে
তবুও, এই নিঝুম আঁধারে কয়েকটি লাশ ছড়িয়ে দিয়েছে সুবাস বাতাস-
কোনো কোনো মানুষের রক্তের ভেতরে
সেইসব শবের পাশে কানামাছি রাতে বসে থাকে কালু ডোম একাকী
যদিও সে একা নয় কখনো সে মৃতদের সাথে কথা কয়-
বলে : এখনো একটি বেওয়ারিশ লাশ মাটির গভীরে ঘুমাতে বাকী
লোকে বলে এই লাশ নাকি মানব সভ্যতা নিয়ে খেলেছিল ধর্মতাস
তাই সে মর্গে শুয়ে আছে মাসের পর মাস

আজ রাতে শহর ঘুমিয়ে গেলে এই লাশটিকে করতে হবে দাফন
এই শীতের মায়বী কুয়াশা লাশকে যেন পরিয়েছে সাদা কাফন

এখন গভীর রাত, ঝিঁঝিঁপোকারাও ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরেছে
শুধু কালু ডোমের ঠেলাগাড়িতে জেগে আছে সেই বেওয়ারিশ লাশ
একবার কালু ডোম ঠেলার পিছনে এসে দেখে-  কী সর্বনাশ,
লাশের বাম পায়ে নেই কোনো সামাধির টোকেন
এবার সে কি করে, এই লাশকে সমাধি দিবে ধর্ম অনুসারে
যেহেতু সে প্রতিবারে লাশের এই টোকেন দেখে-
হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিষ্টান অনুসারে- যার যার ধর্ম মতে গোর দ্যায় কবরে

আরো গভীর রাতে
কালু ডোম সমাধির চৌরাস্তায় এলে পরে খানিক দাঁড়িয়ে ভাবে-
আমার চারিপাশে থাকা, চার ধর্মের কোন গোরে- এই লাশ রাখা যাবে
তারপর সে নিজেই কাফন খুলে হারিকানের আবছা আলোতে দেখে-
এটি একটি কিশোর কিংবা কিশোরীর লাশ
যেন পৃথিবীর সব মায়া জড়িয়ে তার মুখে
আবার বুকের দিকে তাকিয়ে দেখে- থ্যাৎলানো বুক
আরো নিচে তাকিয়ে দেখে- কালো রক্তে ক্ষতবিক্ষত জনুসন্ধি
এই লাশটি যেন মনে করিয়ে দিল তার ছোট্ট মেয়ের কথা
এভাবেই সে লাশটির পিতৃত্বের বন্ধনে হয়ে গেল বন্ধী

লাশের জনুসন্ধি দেখে তার আর ধর্ম নির্ণয় হলো না
এখন সে কি করে- কোন ধর্মের কবরে রাখবে তারে
প্রথম সে বেছে নিলো হিন্দু ধর্মের সমাধি, কিন্তু কোনো সায় দিলো না তার মন
এভাবে সে মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ধর্মের সমাধির পাশে লাশটি রেখে ব্যর্থ হলো বারেবারে

সেই সময়ে অন্ধকার ঝাড়ু দিয়ে পূর্বদিগন্তে প্রসারিত হচ্ছে সূর্য
তারপর সে সূর্যের দিকে দুইহাত নত করে বলে উঠলো-
হে সূর্য পৃথিবীতে এমন কোনো সমাধি নেই, যেখানে একজন মানুষের লাশ দাফন করা যায়
তবে জেনে রাখ- আজ আমি এমন সমাধি রচনা করবো
যেখানে কোনো হিন্দু নয় মুসলিম নয় বৌদ্ধ নয় খ্রিষ্টান নয়
শুধুই মানুষের মৃতদেহ দাফন করা যাবে


ডোম সিরিজ 

সে এলো- চুপিসারে, আঁধারে যেভাবে আসে শিশির
শরীরে তার সন্ধ্যা মেখে- সূর্য ডুবালে হৃদয়ের গভীরে
তাই পৃথিবীতে আজ নবান্নের অন্ধকার কিংবা মৃত আলোর কিচিরমিচির।
মৃত কিংবা জীবিত আলোর আইলে দাঁড়িয়ে রইলেন একজন কবি
তিনি মৃতদেহের অন্ধকার কেটে আলোর ফুল ফোটান পৃথিবীর টবে
সেই শব ফুলের গন্ধে ভরে ওঠে মানুষের জন্মান্ধ মন-নয়ন।

তবুও আমি  তুমি মৃত মানুষ হয়ে- মাটির গভীরে মাটি হয়ে বাঁচি
আবার স্মৃতিসন্ধ্যায় ডোম হয়ে শিশিরের জলে ভিজে বলি :
হে অন্ধ পৃথিবীর মানুষ তোমরা জানো কী-
ডোমেরা কেন মৃত মানুষের চোখের জল মুছে, মৃত হয়ে কাঁদে?
কিংবা বাসি ফুলের মতো মৃত্যু ঘনিয়ে এলে-
আবার জীবিত হয় তোমাদের মৃতদেহের অন্ধকারে।

এসব জীবিত  মৃত শবের উপখ্যান লিখে রাখেন এক ডোমকবি
যার মাথার ভেতর সহস্র জোনাকি আলো জ্বালে অথবা ফুল হয়ে ফোটে।


ডোম সিরিজ 

সকল রং এক সরল রেখায় এসে সাদা হয়ে যায়
এসব কথা লাশের কাফনে- বাতাসের রঙে লেখা আছে।
বাতাস রঙের লেখা পাঠ করতে পারে এক ডোম
অথচ সে বলতে পারে না, মানুষ কেন মরে গেলে সাদা হয়ে যায়।
যদিও তার পূর্ব পুরুষ মৃত মানুষের হাতের রেখা দেখে প্রথম ভেবেছিলেন
পৃথিবীর একটি মানচিত্র দরকার
সেই থেকে পৃথিবীর মানচিত্র হলো হাতের রেখার মতো।

তোমার  আমার রক্তের ভেতর এসব ইতিহাস লেখা আছে
তাই মানুষ মারা গেলে মৃতদেহ সাদা হয়ে যায়,
রজনীগন্ধার পাপড়ির মতো সাদা  সুগন্ধ ছড়ায় আমাদের মৃতদেহ থেকে।
যদিও এসব গন্ধ জীবিত মানুষের খুবই অসহ্য
তাই জীবিতরা মৃতদের ভাসায় অগ্নিস্নানে কিংবা পুতে রাখে কবরে।


ডোম সিরিজ 

শান্ত জলের ভেতর পাখির ছায়া যেভাবে উড়ে যায়
আমিও এমনি করে একদিন জলের ভেতর পানি হয়ে উড়ে যাব।
কিংবা দাস প্রভুদের খোঁয়াড় ভেঙে পাখি হয়ে উড়ব অবিরল রৌদ্রছয়ায়
সেদিন আমার সম্মুখে হলুদ কাশফুল অথবা সবুজ বিড়াল থই থই নাচবে।

তারপর অনেক দিন কেটে যাবে স্বপ্নের ভেতর-
প্যান্টি পড়ে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকবে সোনালি সকাল
ডানা ভাঙা রোদের পিঠে চড়ে আসবে তুমি
তখন আমার হাততালি অসুখ আবার দেখা দিবে।
সেই হাততালির শব্দে মৃতরা আসবে-মৃত্যুর শবযাত্রায়
শবযাত্রাটি শ্মশান থেকে কবর থেকে ধাবিত হবে সংসদের দিকে।

অবশেষে একদিন আমার মৃতদেহ সেই শান্ত জলে- পাখির ছায়া হয়ে ভাসবে।


No comments:

Post a Comment